ঋণখেলাপিদের জন্য খুলে যাচ্ছে ব্যাংকের ভল্ট

ব্যাংক আইন সংশোধন

0
251
জাতীয় সংসদ ভবন

আগে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হয়ে গেলে গোষ্ঠীটির অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ পাওয়ার সুযোগ ছিল না। জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি সংশোধন করে সেই সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের জন্য খুলে যাচ্ছে ব্যাংকের ভল্ট।

খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন আইনের ফলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়ে পড়বে এবং বাড়বে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এ কারণে সার্বিকভাবে ঝুঁকিতে পড়বে আমানতকারীদের স্বার্থ।

কয়েকজন ব্যাংক পরিচালক চলতি মাসে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এক লিখিত প্রস্তাবে জানিয়েছিলেন, গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠান যাতে ঋণখেলাপের কারণে ঋণসুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। তাঁরা বলছিলেন, ঋণ ইচ্ছাকৃত খেলাপি না হলে বা যুক্তিসংগত কারণে ঋণখেলাপি হয়ে পড়লে সেই ঋণ খেলাপি হিসেবে গণ্য হবে না। এসব প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংকগুলো।

ব্যাংক পরিচালকেরা যখন এই প্রস্তাব জমা দেন, তখন সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়াতে এমন কোনো ধারা ছিল না। আইনটি তখন অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে মতামত দেওয়ার জন্য ছিল। এই কমিটি তাদের যে মতামত সংসদে পেশ করে, তাতেও ব্যাংক পরিচালকদের এই প্রস্তাব স্থান পায়নি।

সংসদে আইনটি পাসের দিন সরকারি দলের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম ২৭(কক) ধারার সংশোধনের প্রস্তাব আনেন। তিনি যেভাবে ওই নির্দিষ্ট ধারা সংশোধনের প্রস্তাব আনেন, অনেকটা একই রকমভাবে ব্যাংক পরিচালকেরা তাঁদের সংশোধনের প্রস্তাব সরকারের উচ্চপর্যায়ে জমা দিয়েছিলেন।

আহসানুল ইসলাম প্রস্তাব করেন, ‘কোন খেলাপি গ্রহীতার অনুকূলে কোন ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনোরূপ ঋণ সুবিধা প্রদান করিবে না: তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ২৭ এর দফা (গগ) এর বিধান অনুসারে পরস্পর স্বার্থসংশ্লিষ্ট গ্রুপভুক্ত কোন খেলাপি ব্যক্তি বা ক্ষেত্রমত, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি যদি ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা না হয় অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট যদি ইহা প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কর্তৃক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইবার ক্ষেত্রে যুক্তিসংগত কারণ রহিয়াছে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি খেলাপি হইবার কারণে ওই গ্রুপভুক্ত অন্য কোন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি খেলাপি বলিয়া গণ্য হইবে না, এবং এইরূপ প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন সাপেক্ষে তৎকর্তৃক জারীকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী ঋণ সুবিধা প্রদান করা যাইবে।’

সংসদে কণ্ঠ ভোটে এই প্রস্তাব পাস হয়ে যায়। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা অবশ্য এর প্রতিবাদে সংসদ থেকে বের হয়ে যান।

আগের আইন অনুযায়ী, গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও খেলাপি হয়ে পড়ত। এর ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেশি ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আইন সংশোধনের ফলে সাময়িকভাবে খেলাপি ঋণ কমতে পারে। কারণ, একটি প্রতিষ্ঠানের কারণে অনেক সময় পুরো গ্রুপের ব্যবসা বন্ধ হয়ে পড়ছিল। তবে খেলাপি হয়ে পড়া গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিলে গ্রুপটি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, সেটা দেখার ব্যাপার। এর আগে এই প্রক্রিয়ায় একটি গ্রুপকে অর্থায়ন করা হলেও সেটি ভালো পারতে পারেনি। পাশাপাশি খেলাপি উদ্যোক্তাকে ঋণ দেওয়াটা বিদেশি ব্যাংক ও সহযোগী সংস্থাগুলো কীভাবে দেখবে, এটাও চিন্তার বিষয়।

গত দেড় দশকে ভোগ্যপণ্যের বাজারের ওঠানামা, জাহাজভাঙা ব্যবসায় উত্থান-পতন ও বিভিন্ন কারণে অনেক ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই চট্টগ্রাম অঞ্চলের ব্যবসায়ী। ঋণখেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দিতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী এ বিষয়ে বলেন, ‘যাঁরা ঋণখেলাপি, এখন তাঁদের যতটা সম্ভব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ তো কমবেই না, বরং ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়ে পড়বে। ব্যাংকগুলোতে থাকা আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। উন্নয়নশীল দেশ গড়তে একটি শক্তিশালী ব্যাংক খাত প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্ত তার অন্তরায়। আমানতকারীদের অর্থের এমন ব্যবহার হবে, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি-মার্চে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। ফলে গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণ কমানোর পথ খুঁজছে, দিচ্ছে নানা নীতি ছাড়।

এদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়েছে। এখন বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের কম হলেও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে তা ২০ শতাংশের বেশি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংককে চলতি জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক চারটি হলো সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক।

সানাউল্লাহ সাকিব

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.