নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে ইলিশ মাছ ধরায় চলছে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ১২ দিনে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন নদীতে এটি কাগুজে নিষেধাজ্ঞায় পরিণত হয়েছে। খোদ জেলেরাই জানিয়েছেন, প্রশাসনকে টাকা দিয়ে ইলিশ ধরার ‘পাস’ পেয়েছেন তারা। এ কাজে মাধ্যম হিসেবে আছেন ক্ষমতাসীন দলের
স্থানীয় প্রভাবশালীরা। রাত হলেই পাস নিয়ে নদীতে নামছে কয়েক হাজার জেলে নৌকা। নদীপাড়েই চলছে বিকিকিনি। ইলিশের ভাগ পাওয়ায় প্রশাসন নীরব দর্শক। যদিও জোরালো সাইরেন বাজিয়ে প্রায়ই তারা দায়সারা অভিযান চালাচ্ছে। সরেজমিন জেলেদের সঙ্গে কথা বলে ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। হিজলা ও পাশের মেহেন্দীগঞ্জের অন্তত পাঁচটি পয়েন্টে অবাধে চলছে ইলিশ নিধন। এর মধ্যে হিজলা-গৌরবদীর জানপুর হটস্পট। হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ টিপু, সাধারণ সম্পাদক ও বড়জালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন হাওলাদার এবং সহসভাপতি ও হিজলা-গৌরবদী ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মিলন প্রতিনিধি নিয়োগ করে কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় রাজনীতিতে তিন নেতা তিন মেরুতে থাকলেও ইলিশ নিধনে এক হয়েছেন। প্রশাসনের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ের দায়িত্বে আছেন উপজেলা মৎস্য অফিসের মাঝি সাইদুল ইসলাম। সবাইকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে হিজলা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এম এম পারভেজের বিরুদ্ধে।
সরেজমিন জানপুরের ৩ নম্বর খালের মুখে কমপক্ষে আড়াই হাজার জেলে নৌকা দেখা যায়। রাতে শরীয়তপুর ও ভোলার জেলেরা এখানে জড়ো হন। রাতভর মাছ ধরে তীরেই চলে বেচাকেনা। ইলিশ ১৮টি স্পিডবোটে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে শরীয়তপুর ও মাওয়ায়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শরীয়পুরের গোসাইরহাট, চাঁদপুরে হাইমচর ও হিজলা সীমানার মেঘনার জানপুর অংশ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে নিয়ন্ত্রণ করছেন হিজলা-গৌরবদীর চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মিলন। মেঘনা তীরে রয়েছে তাঁর ২৪টি মাছঘাট। গত বছর মিলন দলের পদ হারালে নতুন সাধারণ সম্পাদক চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন দুটি ঘাট স্থাপন করেন। এরপর থেকে জানপুর পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণে আছেন সুলতান মাহমুদ টিপু সিকদারের প্রতিনিধি আবুল মৃধা ও তাজুল ইসলাম ফকির, এনায়েত হাওলাদারের প্রতিনিধি তাঁর ভাগনে মারুফ গাজী ও ভাগনি জামাই আজাদ সরদার, নজরুল ইসলাম মিলনের পক্ষে তাহের বেপারি, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন ও আলাউদ্দিনের জামাতা ফরহাদ রাঢ়ী এবং ৩ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার কালাম সরদার ও স্থানীয় জেলে সংগঠনের নেতা ইদ্রিস দেওয়ান। প্রশাসনকে ম্যানেজ করার কথা বলে জেলেদের কাছ থেকে নৌকাপ্রতি ২ হাজার টাকা আদায় করেন সুফিয়ান সরদার ও ইউসুফ সরদার। ইলিশ পরিবহনের স্পিডবোট নিয়ন্ত্রণ করেন জসিম সরদার।
এনায়েত হাওলাদার বলেন, ‘আমি নই, ইলিশ ধরছে মিলন চেয়ারম্যানের লোকজন জড়িত। অভিযোগ পেয়ে ভাগনেকে বকাঝকা করে কাছে আসতে নিষেধ করেছি।’ তবে নজরুল ইসলাম মিলনের দাবি, ‘জানপুরের অংশটি শরীয়তপুরের গোসাইরহাটে। সেখানে কিছু হলে আমার কী করার? আমার নামে প্রতিপক্ষরা মিথ্যাচার করছেন।’ হিজলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ইকবাল হোসেন মাতুব্বর বলেন, ‘জানপুরের সীমানার অজুহাত তুলে চক্রটি বরাবরের মতো এবারও ইলিশ নিধনের উৎসব চালাচ্ছে। ক্যাম্প পুলিশ নিজেরাই তো ম্যানেজ হয়ে থাকে। এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা।’
অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এম এম পারভেজ বলেন, ‘প্রশাসনের সহায়তায় মেঘনায় প্রতিদিন অভিযান হচ্ছে। মৎস্যসম্পদ রক্ষায় জনপ্রতিনিধিসহ সবার সহযোগিতা চাচ্ছি।’ মাঝি সাইদুলের বিষয়ে তিনি জানান, তাঁর একাধিক মাঝি আছেন। কাউকে নিয়মিত দায়িত্বে রাখা হয় না।
হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুদীপ্ত কুমার সিংহ বলেন, ‘জানপুর তিন নদীর মোহনা ও দুর্গম এলাকা। অভিযানকারীদের জলযান দেখেই নৌকাগুলো বিভিন্ন খালে ঢুকে পালিয়ে যায়।’ গত রোববার পর্যন্ত জেলায় ৪৮১টি অভিযানে ৩০৩ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড, ৪ লাখ ৪৫২ মিটার জাল জব্দ ও ২৯০টি মামলা হয়েছে। এদিকে ভোলার চরফ্যাসনে রাতে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে চলছে ইলিশ শিকারের উৎসব। প্রশাসনকে ঘুষ দিয়ে রাতে মাছ শিকারের ‘পাস’ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলেরা। রাতে ধরা ইলিশে মেঘনাপাড়েই জমে উঠছে হাট। সেখান থেকে নিয়মিত ঘুষ হিসেবেও পুলিশ ইলিশ নিচ্ছে বলে অভিযোগ জেলেদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নতুন স্লুইসঘাট ও গাছির খাল ঘাটের একাধিক জেলে জানান, প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘাটে ঘাটে দালাল রেখে তাদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে নিষিদ্ধ সময়ে মাছ শিকারের ‘পাস’ দিয়েছেন। নুরাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রতি রাতেই মা ইলিশ শিকার চলছে। নদীর পাড়েই উন্মুক্ত হাটে বিক্রি হচ্ছে। মৎস্য বিভাগ ও পুলিশকে জানালেও কাজ হয় না।’ উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিনার জানান, তাদের দুটি দল নিয়মিত টহল দিচ্ছে। এ পর্যন্ত ৪৮ জেলেকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। টাকা নিয়ে ধাছ ধরতে দেওয়ার তথ্য জানা নেই বলে জানান তিনি।
সুমন চৌধুরী, বরিশাল ও নোমান সিকদার, চরফ্যাসন (ভোলা)