এবারের ঈদের ছুটিসহ গত ১০ দিনে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে অন্তত আট লাখ পর্যটক এসেছেন। সমুদ্রের নীল জলে নেমে গা ভেজানো পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু প্রায় সময় দেখা যায়, গুপ্তখাল কিংবা স্রোতের টানে ভেসে পর্যটকের মৃত্যু হচ্ছে বা তাঁরা বিপদে পড়ছেন। গেল কয়েক দিনে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে সৃষ্ট গুপ্তখালে আটকা পড়ে দুই পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে অন্তত ৩০ জনকে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্যমতে, গত ১৮ বছরে সমুদ্রে গোসলে নেমে মারা গেছেন অন্তত ১২৬ জন পর্যটক। সৈকতে গুপ্তখাল সৃষ্টি, পর্যটকের নিরাপদ গোসলসহ নানা বিষয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দারের সঙ্গে।
সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার: অনেক সময় দেখা যায়, খুব অল্প গভীরতায় গোসল করতে নেমে মানুষ সাগরের স্রোতে ভেসে গিয়ে মারা যান। এ ধরনের মৃত্যুর কারণ রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোত। উল্টো স্রোত যেখানে দেখা যাবে, ধরে নিতে হবে যে তার নিচে (সাগরের তলদেশে) গুপ্তখাল বা ডিপ ক্যানেল আছে। উল্টো স্রোত হচ্ছে স্থানীয় স্রোত, যা উপকূল রেখা থেকে সমুদ্রের দিকে লম্বা অথবা তীরের তীব্র কোণে প্রবাহিত হয়। সমুদ্রসৈকত সাধারণভাবে তির থেকে সাগরের দিকে ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে। কিন্তু কখনো কখনো প্রাকৃতিক বা ভৌগোলিক কারণে সৈকত তীর থেকে কিছু দূরে সমুদ্রতল কিছুটা উঁচু হয়ে একটি বাঁধ, প্রাচীর বা রিপ তৈরি করে। সৈকতের নিকটবর্তী এই বাঁধ বা প্রাচীরের উচ্চতা সমান না হলে, সমুদ্রের ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ে সাগরে ফিরে যাওয়ার সময় নিচু স্থানটিতে একটি চিকন পথ তৈরি করে প্রবল বেগে সমুদ্রে ফিরে উল্টোমুখী প্রবাহ অথবা স্রোত তৈরি করে। এটিই মূলত রিপ কারেন্ট বা উল্টো স্রোত। উল্টো স্রোত যেখানে, সেখানেই গুপ্তখাল থাকে।
সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার: উল্টো স্রোত মানুষকে পানির তলার দিকে টেনে ডুবিয়ে দেয় না বরং উপকূল থেকে মানুষকে দূরে টেনে নিয়ে যায়। উল্টো স্রোত সাধারণত নিচের দিকে সবচেয়ে শক্তিশালী হয়, যার ফলে একজন পর্যটকের পা নিচ থেকে ছিটকে যেতে পারে; এতে তাঁর মনে হয় যেন পানির নিচে কিছু একটা তাঁকে টানছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং তীরের দিকে প্রবল শক্তিতে সাঁতার কাটতে থাকেন। একপর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে সাগরে ভেসে যান। ভয়, আতঙ্ক, ক্লান্তি বা সাঁতারের দক্ষতার অভাবে মানুষের মৃত্যু হয়। উল্টো স্রোতে পড়লে আতঙ্কিত না হয়ে, মনোবল না হারিয়ে এবং সাঁতার কাটার চেষ্টা না করে নিজেকে ভাসিয়ে রেখে ধীরে ধীরে উল্টো স্রোত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।
সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার: উল্টো স্রোত যে স্থানে তৈরি হয়, সেখানকার জল আপাতদৃষ্টে খুবই শান্ত দেখায় এবং জলরাশি অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ থাকে। আশপাশের তুলনায় এখানে ফেনিল কোনো ঢেউ দেখা যায় না। উল্টো স্রোত ছোট এলাকা নিয়ে তৈরি হলেও বেশ খরস্রোতা হয়ে থাকে, যা তুখোড় সাঁতারুকেও হার মানায় এবং সাঁতারুকে গভীর সাগরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। যে জায়গাতে গুপ্তখাল আছে সে জায়গাটা দূর থেকে দেখলে মনে হয় শান্ত। পর্যটকেরা মনে করেন যে ওটা শান্ত এলাকা, ঢেউও কম, সুতরাং গোসলে নেমে পড়ি। উল্টো স্রোত কিংবা গুপ্তখাল উপকূলে যেকোনো স্থানে সৃষ্টি হতে পারে, যা অনেক সময় খালি চোখে দেখে যায় না। সমুদ্রে গোসলে নামার আগে পর্যটকদের অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার: অবশ্যই আছে। সৈকতে গোসলে নেমে ভেসে যাওয়া লোকজনদের উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত আছেন ৫০ জনের বেশি লাইফগার্ড কর্মী। তাঁদের কাছে উন্নতমানের ড্রোন দেওয়া গেলেই এটা করা সম্ভব। ড্রোনের মাধ্যমে গভীর সাগরের কোথায় কী হচ্ছে, পর্যবেক্ষণ করা যায়। তখন জানা যাবে, কোন জায়গাতে উল্টো স্রোত তৈরি হয়েছে। উল্টো স্রোত যেখানে তৈরি হবে, সঙ্গে সঙ্গে সেই জায়গায় লাল নিশান উড়িয়ে দিতে হবে। কোনোভাবেই সেখানে পর্যটকদের গোসলে নামতে দেওয়া যাবে না। ড্রোন পরিচালনা খুব কঠিন কাজ না। লাইফগার্ড কর্মীদের মাধ্যমেও ড্রোন পরিচালনা সম্ভব, সামান্য প্রশিক্ষণ দিয়েই।
বিশ্বের দীর্ঘতম ১২০ কিলোমিটার সৈকতের কোথাও পর্যটকের নিরাপদ গোসলের ‘সুইমিং জোন’ নেই। অথচ সৈকতকে ঘিরে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক হোটেল–মোটেলসহ অনেক কিছু…
সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার: বিশ্বের বিভিন্ন সৈকতের মতো কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতেও ‘সুইমিং জোন’ থাকা উচিত। কিন্তু কয়েক যুগেও কেন এটা হলো না, তা বোধগম্য নয়। বালুকাময় বিচে উল্টো স্রোত বেশি হয়। এ জন্য নিরাপদ গোসলের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় নেট (জাল) দিয়ে ঘিরে সুইমিং জোন করা দরকার। স্রোতের টানে পর্যটক ভেসে গেলে যেন নেটে আটকে থাকে।