উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব-কোন্দল চরমে উঠেছে। দলীয় এমপি ও মন্ত্রীর স্বজনের ভোটের মাঠে সরব উপস্থিতি এই কোন্দল বাড়িয়ে তুলছে। এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও নেতৃত্ব ধরে রাখতে দলের স্থানীয় নেতারাও স্বজন এবং ঘনিষ্ঠদের প্রার্থী করেছেন।
এদিকে এমপি-মন্ত্রীদের স্বজনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশও মানেননি কেউ। দল থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারিতেও কাজ হয়নি। এই অবস্থায় আগামী ৩০ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
চারধাপের ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করতে আওয়ামী লীগ থেকে কাউকেই দলীয় প্রতীক নৌকা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় গত ২২ জানুয়ারি দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি বৈঠকে। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষমতাসীন দলটি।
পরে দলীয় কোন্দল এড়াতে উন্মুক্ত এই নির্বাচনে কোনো এমপি-মন্ত্রী তাঁর স্বজন কাউকে প্রার্থী ঘোষণা করতে পারবেন না কিংবা প্রভাব বিস্তার বা হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না বলেও দলীয় নির্দেশনা জারি হয়।
তবে এই নির্দেশনা উপেক্ষা করে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপি, মন্ত্রী এবং নেতারা তাদের ছেলে, ভাই, স্ত্রী ও শ্যালকসহ স্বজন এবং ঘনিষ্ঠদের প্রার্থী করে মাঠে নামেন। এতে বিভিন্ন স্থানে নতুন করে কোন্দল তৈরি হয়েছে। তৃণমূলের ত্যাগী নেতাসহ অন্য প্রার্থীদের হুমকি-ধমকি দিয়ে ভোটের মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক ও নাটোরের সিংড়া উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী অধ্যক্ষ লুৎফুল হাবীব রুবেল এবং তাঁর সহযোগীদের হাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী দেলোয়ার হোসেনকে অপহরণ ও মারধর করে গুরুতর আহত করার ঘটনাও ঘটে।
এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দলের পক্ষ থেকে সব মন্ত্রী-এমপির স্বজনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেও এই আহ্বান জানান। যদিও গত সোমবার প্রথম ধাপের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময়সীমা পার হলেও অধ্যক্ষ লুৎফুল হাবীব রুবেল ছাড়া অন্য কোনো মন্ত্রী-এমপির স্বজনই প্রত্যাহার করেননি। উল্টো গত রোববার শেষ হওয়া ২১ মে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন এমপি-মন্ত্রীর স্বজন বিভিন্ন উপজেলায় নতুন করে প্রার্থী হওয়ায় জটিলতা বেড়েছে।
যদিও উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া এসব এমপি-মন্ত্রীর স্বজনের দাবি, দলীয় নির্দেশনায় স্বজনের ব্যাখ্যা পরিষ্কার ছিল না। তা ছাড়া মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই ও চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরই এমন নির্দেশনা এসেছে। ততদিনে ভোটের মাঠে অনেকটা এগিয়ে গেছেন তারা। ফলে তাদের পক্ষে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা সম্ভব হয়নি।
প্রথম ধাপে ১৫০টি উপজেলায় আগামী ৮ মে এবং দ্বিতীয় ধাপে ১৬০টি উপজেলায় ২১ মে ভোট গ্রহণ হবে। এর মধ্যে প্রথম ধাপের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার শেষ হওয়ার পরও কমপক্ষে ৩৩টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৪৭ জন প্রার্থীর খোঁজ মিলেছে, যারা স্থানীয় এমপি ও মন্ত্রীর স্বজন কিংবা নিকট আত্মীয়। ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদেও এমন অনেক প্রার্থী রয়েছেন। আবার প্রথম ধাপে যে ২৬ জন প্রার্থী এরই মধ্যে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন, তাদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন এমপি-মন্ত্রির স্বজন রয়েছেন।
এদিকে গত রোববার মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে এমপি-মন্ত্রীর স্বজন প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ জনের মতো। যদিও ৩০ এপ্রিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার শেষে এই সংখ্যা কিছুটা কমতে পারে। এ ছাড়া ২৯ মে অনুষ্ঠেয় তৃতীয় ধাপের ১১২টি এবং ৫ জুন অনুষ্ঠেয় ৫৪টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্যও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এমপি-মন্ত্রীর স্বজন প্রার্থী হওয়ার জোরালো প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
দলীয় চাপ উপেক্ষা করেই এমপি-মন্ত্রীদের এসব স্বজন শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা বহাল রাখার প্রশ্নে অনড় আছেন। তবে কেউ কেউ আবার প্রথম ধাপে প্রার্থী হওয়া এমপি-মন্ত্রীর স্বজনদের বিরুদ্ধে দল থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন। ৩০ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক থেকেও নতুন সিদ্ধান্ত আসার অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকে। স্বজনদের প্রার্থিতার প্রশ্নে দলীয় সভাপতির সদয় দৃষ্টি কামনা করছেন কেউ কেউ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম ধাপে মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান এমপির ছেলে আসিবুর রহমান খান। এমপিপুত্রের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পাভেলুর রহমান খান শফিক, যিনি শাজাহান খানের চাচাতো ভাই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করে দু’জনই প্রার্থী হিসেবে রয়ে গেছেন। বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের তর্ক-বিতর্ক ও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ঘটনা ঘটে।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপির ফুপাতো ভাই ইসরাফিল হোসেন। দু’দফায় দলীয় প্রতীক নৌকা নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর এবার তৃতীয়বারে মতো প্রার্থী তিনি। ইসরাফিল হোসেন বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত তাঁর জন্য প্রযোজ্য হবে না। কারণ দীর্ঘদিন থেকে দলীয় পদে থাকা ছাড়াও দল তাঁকে দু’বার মনোনয়ন দিয়েছিল। বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন তিনি।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে একরামুল করিম চৌধুরী এমপির ছেলে আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরীও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। এ নিয়ে সেখানে দ্বন্দ্ব-কোন্দল চলছে। গত মঙ্গলবার নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলন করে দলীয় প্রধানের আদেশ অমান্য করে নিজের ছেলেকে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করায় একরামুল করিম চৌধুরীর এমপি পদ স্থগিতের দাবি জানিয়েছে।
নির্দেশনা অমান্য করে এখনও যেসব এমপি-মন্ত্রীর স্বজন উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে রয়ে গেছেন তারা হচ্ছেন– পাবনার বেড়ায় ডেপুটি স্পিকার শামসুল আলম টুকুর ভাই আব্দুল বাতেন ও ভাতিজা আব্দুল কাদের সবুজ; কুমিল্লার লাকসামে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলামের শ্যালক মহব্বত আলী ও মনোহরগঞ্জে তাজুলের ভাতিজা আমিরুল ইসলাম, নরসিংদীর পলাশে আনোয়ারুল আশরাফ খান এমপির স্ত্রীর বড় ভাই ও ঘোড়াশাল পৌরসভার সাবেক মেয়র শরীফুল হক, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে সাহাদারা মান্নান এমপির ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজল, সোনাতলায় সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামান লিটন, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি দ্রৌপদী দেবী আগরওয়ালার পুত্রবধূ প্রিয়া আগরওয়ালা; চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় আলী আজগর টগর এমপির ছোট ভাই ও উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মুনসুর বাবু; পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় নাঈমুজ্জামান ভূঁইয়া এমপির স্বজন ও বর্তমান চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু এবং তাঁর ছোট ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানসহ অনেকে।
উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নোয়াখালীর হাতিয়ায় মোহাম্মদ আলী এমপির ছেলে আশিক আলী এবং মুন্সীগঞ্জ সদরে ফয়সাল বিপ্লব এমপির চাচা আনিস উজ্জামান আনিস এরই মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকলেও মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি তারা। পরে কৌশল ও প্রভাব খাটিয়ে অন্য প্রার্থীদের সরিয়ে দিয়ে তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথ সুগম করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা এমনটাও বলছেন, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত প্রথম ধাপের নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময়সীমা পার হলেও ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর সময় শেষ হয়ে যায়নি। একজন প্রার্থী চাইলে নির্বাচনের আগ মুহূর্তেও সরে দাঁড়াতে পারবেন। তাই এমপি-মন্ত্রীর স্বজনের সরে দাঁড়ানোর জন্য নির্বাচনের আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর পরও যারা ভোটের মাঠ থেকে সরবেন না, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রথম পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় পেরিয়ে গেলেও ভোটের আগের দিন পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে প্রার্থী নিজেই প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে পারেন। তাই এমপি-মন্ত্রীর স্বজনের ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য আওয়ামী লীগ শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। এখানে দলের সিদ্ধান্ত কেউ অমান্য করলে সময় মতো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত মানা দলের সব নেতাকর্মীর জন্য বাধ্যতামূলক। তা না হলে দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দলের কার্যনির্বাহী বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জানান, এখনও তারা চেষ্টা করছেন, এমপি-মন্ত্রীদের স্বজন যেন উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। যদি কেউ নিজেদের ভোটের মাঠ থেকে প্রত্যাহার না করেন, তাহলে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।