দুই সপ্তাহের কিছু বেশি হলো নিউইয়র্কে এসেছি। উদ্দেশ্য নাতিদের সঙ্গে সময় কাটানো। এখন আমেরিকায় স্কুলগুলোতে গ্রীষ্মের ছুটি। স্কুল বন্ধ হলেও চলছে নানা শিক্ষাক্রমবহির্ভূত ক্যাম্প। বড় নাতি যায় বেসবল খেলার ক্যাম্পে এবং ছোট নাতি সায়েন্স ক্যাম্পে। তারা সকালে ক্যাম্পে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসে। মেয়ে ও জামাইয়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে আমরা তাদের ক্যাম্পে আনা-নেওয়া করি। ফলে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বেশ খানিকটা অবসর। সে সময়ে আমি নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে যাই। উদ্দেশ্য ‘সবুজ ও টেকসই জ্বালানি’ বিষয়ে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসকে ও ‘অ্যাডাম স্মিথ ও বাংলাদেশে অনর্থনীতি চর্চা’ বিষয়ে বাংলার পাঠশালাকে প্রতিশ্রুত দুটি নিবন্ধ লেখা।
উন্নয়ন নিয়ে আত্মতুষ্টি যে বিপদ আনতে পারে
নীতি ও পরিকল্পনা
দুই সপ্তাহের কিছু বেশি হলো নিউইয়র্কে এসেছি। উদ্দেশ্য নাতিদের সঙ্গে সময় কাটানো। এখন আমেরিকায় স্কুলগুলোতে গ্রীষ্মের ছুটি। স্কুল বন্ধ হলেও চলছে নানা শিক্ষাক্রমবহির্ভূত ক্যাম্প। বড় নাতি যায় বেসবল খেলার ক্যাম্পে এবং ছোট নাতি সায়েন্স ক্যাম্পে। তারা সকালে ক্যাম্পে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসে। মেয়ে ও জামাইয়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে আমরা তাদের ক্যাম্পে আনা-নেওয়া করি। ফলে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বেশ খানিকটা অবসর। সে সময়ে আমি নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে যাই। উদ্দেশ্য ‘সবুজ ও টেকসই জ্বালানি’ বিষয়ে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসকে ও ‘অ্যাডাম স্মিথ ও বাংলাদেশে অনর্থনীতি চর্চা’ বিষয়ে বাংলার পাঠশালাকে প্রতিশ্রুত দুটি নিবন্ধ লেখা।
পথচারীর অগ্রাধিকার
হেঁটে, চারটি অ্যাভিনিউ (লম্বালম্বি সড়ক) ও দুটি সড়ক (আড়াআড়ি রাস্তা) পার হয়ে সেখানে যাই। রাস্তায় খানাখন্দ নেই। প্রতিটি অ্যাভিনিউ ও রাস্তার সংযোগস্থলে চারদিকে চারটি করে জেব্রা ক্রসিং। সেখানে যানবাহন ও পথচারী উভয়ের জন্যই সিগন্যাল আছে—যানবাহনের জন্য লাল-সবুজ বাতি আর পথচারীদের জন্য সাদা ও লাল মানুষের ছবি। সাদা মানুষ মানে যাও, লাল মানুষ মানে থামো। লাল হওয়ার আগে, সাদা ছবিটা মিটমিট করে বা বড় সংখ্যা ২০ থেকে কমতে কমতে ১, পরে শূন্য হয়ে স্থির হয়ে যায়। সব রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নেই। কিন্তু গাড়িচালকেরা ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে পথচারীদের রাস্তা পার হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। এমনকি যানবাহনের জন্য সবুজসংকেত থাকলেও রাস্তায় যদি কোনো মহিলা বা বয়স্ক পথচারী পার হতে থাকেন, তাহলে গাড়ি থেমে থাকে। হর্ন বাজানো প্রায় বিরল।
নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি
আমি ৫৮তম সড়কের পাবলিক লাইব্রেরিতে যাই। সকাল ১০টায় খোলার আগেই সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে সব বয়সের মানুষ—বুড়ো, তরুণ, কিশোর, স্ট্রলারে শিশু, নারী, পুরুষ, বালক ও বালিকা। লাইব্রেরিতে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত—কেবল সদস্যদের জন্য। তাই আমার লাইব্রেরি কার্ড করতে হলো। সময় লাগল ১ মিনিট ১৩ সেকেন্ড। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম পাসপোর্ট ও প্রুফ অব রেসিডেন্স। দিতে হলো চারটি তথ্য—নাম, ই-মেইল অ্যাড্রেস, ফোন নম্বর ও চার সংখ্যার একটি পিন। কার্ডটি নিউইয়র্ক শহরের ৯২টি লাইব্রেরি ও শাখা লাইব্রেরিতে ব্যবহার করা যাবে।
আমাদের এলাকায় পাবলিক লাইব্রেরি নেই
সারা গুলশান, বনানী, বারিধারায় একটিও পাবলিক লাইব্রেরি নেই। এ লজ্জা রাখি কোথায়? কিন্তু কেন? আপাতত এর দুটি ব্যাখ্যা পেয়েছি। প্রথম ব্যাখ্যাটি দিয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা পঙ্কজ বড়ুয়া। তাঁকে হুবহু উদ্ধৃত করছি, ‘২০০৫-এ সদ্য রিটায়ার করেছি। রাজধানীর বিত্তবানদের উল্লিখিত এলাকার এক বন্ধু জানতে চাইল, আমি কীভাবে সময় কাটাই। তাকে জানালাম, প্রতিদিন ৯-১০টায় কেন্দ্রীয় সেনা গ্রন্থাগারে যাই। ওখানে অনেকটা সময় কাটাই। সে আমার নিকট জানতে চাইল লাইব্রেরিতে আমার কী কাজ, ওখানে কী করি ইত্যাদি। এটাই উক্ত এলাকাসমূহে লাইব্রেরি না থাকার মূল কারণ।’ দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি সেদিন পাবলিক লাইব্রেরিতে এসে পেলাম। একজন মহিলা লাইব্রেরিতে নিবিষ্ট মনে পড়ছিলেন। তাঁর পরনে একটি টি-শার্ট, যাতে সামনে লেখা আছে—‘ডিসেন্ট ইজ প্যাট্রিয়টিক’, অর্থাৎ ‘ভিন্নমত দেশপ্রেমসম্মত’। এখানে জেনেশুনে ভিন্নমত প্রকাশের কথা বলা হয়েছে, কেবল মুর্দাবাদ নয়। সম্ভবত জেনেশুনে কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করুক, তা আমরা চাই না। আর হ্যাঁ, নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির স্লোগান হচ্ছে ‘নলেজ ইজ পাওয়ার—জ্ঞানই শক্তি’।
পিনপতন নীরবতা
পাবলিক লাইব্রেরির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এখানকার পিনপতন নীরবতা। একমাত্র লাইব্রেরিয়ানদের সঙ্গে গ্রাহকদের ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে কোনো কথা নেই। প্রথম দিন আমার ফোন চালু ছিল বিধায় বেজে ওঠে। নিমেষেই একজন মৃদুভাষী এসে দৃঢ়ভাবে বলে, পাঠাগারের ভেতর ফোনে কথা বলা নিষেধ। পরদিন থেকে ফোন সাইলেন্ট করে পাঠাগারে ঢুকি। কোনো প্রেমিক যুগলকে বুক শেলফের পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করতেও দেখলাম না। পাঠাগার কেবল বই আদান-প্রদান, পড়া ও লেখার জন্য।
পকেট আইনস্টাইন সিরিজ
দুই সপ্তাহে সবুজ ও টেকসই জ্বালানিবিষয়ক লেখাটির খসড়া প্রায় শেষ করে এনেছি, এমন সময় ই-মেইলে খবর পেলাম, আমার অনুরোধ করা রিনিউয়েবল এনার্জি—টেন শর্ট লেসনস বইটি ইন্টার লাইব্রেরি লোন হিসেবে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। পকেট আইনস্টাইন সিরিজের বইটির লেখক স্টিফেন পিক, প্রকাশ করেছে জন হপকিনস ইউনিভার্সিটি প্রেস। বইটি সত্যিই ছোট—লম্বায় সাত ও চওড়ায় চার ইঞ্চির কাছাকাছি, পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৮৬, সত্যিই প্যান্টের পকেটে রাখা যায়। কিন্তু তা হলে কী হবে? ছোট বইটি তথ্য ও বিশ্লেষণে ঠাসা। বইয়ের লেখক কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পদার্থবিজ্ঞানী। সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে বইটি পড়া শেষ করে দুটি কথা মনে হলো—এক. ইডকলে একসময় সৌরবিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করেছি বিধায় ধারণা ছিল, আমি রিনিউয়েবল এনার্জি সম্পর্কে মোটামুটি জানি। সে ভুল ধারণা ভেঙে গেল। দুই. আগের জানাশোনার পাশাপাশি অন্য সব বই পড়ে মনে হলো, আমার প্রস্তুতকৃত নিবন্ধের খসড়াটি বেশ ভালোভাবেই সংশোধন করতে হবে।
কী আছে বইটিতে
বরং বলা উচিত কী নেই বইটিতে? সেকেন্ড ল অব থার্মোডাইনামিকসসহ পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিতের এনার্জি-সম্পর্কিত সূত্রসমূহের সাধারণের কাছে বোধযোগ্য ব্যাখ্যা ও মেগাওয়াটের মতো কারিগরি বিষয়ের সহজ উদাহরণ। আরও আছে নানা ধরনের নবায়নযোগ্য প্রযুক্তির বিবরণ ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ এবং বিশ্বব্যাপী টেকসই জ্বালানিতে উত্তরণের পথরেখা। মেগাওয়াটের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, একটি ১০০ ওয়াটের তাপদীপ্ত (ইনকেনডিসেন্ট) বাতির সমপরিমাণ আলো পাওয়া যায় একটি ১৫ ওয়াটের সিএফএল অথবা ১০ ওয়াটের এলইডি বাতিতে। তাই তাপদীপ্ত বাতির পরিবর্তে এলইডি বাতি ব্যবহার করলে ৯০ ওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় বা ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এভাবে এক কোটি বাল্ব পরিবর্তন করলে ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ পরিহার করা সম্ভব হয়।
আমাদের ভ্রান্ত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ নীতি
মোটাদাগে বইটির বক্তব্য হলো—(১) জীবাশ্ম জ্বালানির এখন অন্তিম সময়; (২) জ্বালানি সাশ্রয়ই হচ্ছে সবচেয়ে সস্তা জ্বালানি; (৩) কার্বন নিঃসরণ হ্রাস না করার কোনো বিকল্প নেই এবং (৪) নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার ঘটিয়ে সব দেশেই জ্বালানির প্রয়োজন মেটানো সম্ভব।
আমরা ঠিক এর উল্টোটিই করেছি। বেনিয়া স্বার্থে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার কেন্দ্র স্থাপন করেছি, দেশজ গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় এলএনজি আমদানির ব্যবস্থা করেছি। এতে সমস্যার সমাধান তো হয়নি, বরং সামষ্টিক অর্থনীতিতে ঝুঁকি সৃষ্টি করেছি। অথচ প্রতিবেশী ভারতেও ‘কম কার্বন নিঃসরণকারী জ্বালানি সম্প্রসারণের বিভিন্ন পথ’ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। দেশটি জীবাশ্ম জ্বালানিবহির্ভূত সূত্র থেকে তাদের প্রয়োজনের ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা, ইতিপূর্বে নির্ধারিত ২০৩০ সালের ৯ বছর আগেই অর্জন করেছে। এখন তারা ২০৫০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানিবহির্ভূত সূত্র থেকে সব জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
উপসংহারে বলব, পথচারীর মতো সাধারণ মানুষকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে। মূর্খতা নয়, জ্ঞানকে উন্নয়নের ভিত্তি করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা দ্রুত কমিয়ে, জ্বালানি সাশ্রয় ও কার্বন নিঃসরণ হ্রাসকারী নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার করে টেকসই জ্বালানিনীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
স্টিফেন পিকের রিনিউয়েবল এনার্জি—টেন শর্ট লেসনস বইটি কেউ বাংলায় অনুবাদ করলে সবাই উপকৃত হবে।
● মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব