রাজধানীর ধানমন্ডির সাতমসজিদ এলাকার সড়কদ্বীপ উন্নয়নের নামে শুরু হয় গাছ কাটা। এর প্রতিবাদে গত ৩০ জানুয়ারি আন্দোলনে নামেন এলাকাবাসী। এর পর কেটে গেছে তিন মাস। গত সোমবার হঠাৎ একই এলাকায় আবার শুরু হয় গাছ কাটা, তবে এবার গভীর রাতে। রাত পৌনে ২টায় এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে জড়ো হন স্থানীয়রা। ছুটে আসে পুলিশও, বন্ধ হয় গাছ কাটা। তবে এর আগেই কেটে ফেলা হয় শতাধিক গাছ।
শুধু সাতমসজিদ রোড নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়নের নামে এভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে সবুজ। প্রকল্পের পর প্রকল্পের করাতে কাটা পড়েছে বৃক্ষরাজি। আর উধাও হয়ে যাচ্ছে গাছের ছায়া। খাতা-কলমে একটি কাটলে তিনটি গাছ লাগানোর কথা। তবে রাজধানীতে কোথায়, কত বিকল্প গাছ লাগানো হয়েছে– তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। তাপদাহ যখন ঢাকাকে পোড়াচ্ছে, ঠিক তখন গাছ কাটার বিষয়টি নগরবাসীর মনে দাগ কেটেছে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এ ঘটনায় প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়েছে। ধানমন্ডিতে বৃক্ষ ধ্বংস নগর উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। প্রায় ৯ কোটি ৬২ লাখ টাকার এ প্রকল্পের কাজ পায় অনিকা এন্টারপ্রাইজ। গত ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের ৩০ জুনের মধ্যে কাজটি শেষ করার কথা। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর জারি হওয়া প্রকল্পের কার্যাদেশের কোথাও গাছ কাটার কথা উল্লেখ নেই। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি গত জানুয়ারিতে ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে গাছ কাটা শুরু করে। আগের বিভাজক ভেঙে নতুন বিভাজকের জন্য ঢালাই দেওয়া হয়। সরেজমিন দেখা যায়, সাতমসজিদ রোড থেকে জিগাতলার পিলখানা গেট পর্যন্ত সড়ক বিভাজকের অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তখন ‘সাতমসজিদ রোড গাছ রক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে এলাকাবাসী নানা কর্মসূচি পালন করেন। কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর গত সোমবার গভীর রাতে আবার শুরু হয় গাছ কাটা।
গাছ কাটার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন স্থানীয় বাসিন্দা আমিরুল রাজীব। ধানমন্ডিতে এসব গাছ দেখে দেখে তাঁর বেড়ে ওঠা। তিনি বলেন, সোমবার রাতে শতাধিক গাছ কাটা পড়েছে। এর মধ্যে দুটি বটগাছের বয়স ২৫ বছর। পিলখানা থেকে সাতমসজিদ রোড পর্যন্ত প্রায় ৬০০ গাছ কাটা হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগের বয়স ১০-১৫ বছর। উচ্চতা ২০-২৫ ফুট। সব গাছই বেশ সবল ছিল। সরকারই এসব গাছ লাগিয়েছে, এখন আবার সরকারই কেন কাটছে? তিনি বলেন, সড়কে যে বিভাজক তৈরি করা হয়েছে, তাতে ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের পর থেকে ২৭ নম্বর পর্যন্ত রাস্তা পার হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ এলাকার এখন দুর্বিষহ পরিস্থিতি। সবাইকে আটকে ফেলা হয়েছে।
গতকাল বিকেলে সাতমসজিদ সড়ক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সড়কের পাশে একটি ভেকু রাখা। ডালপালা ও গাছের কাটা অংশ বিভাজকের দু’পাশের সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আর অল্প কিছু গাছ সড়কের মাঝে টিকে আছে। এগুলোতেও যে কোনো সময় কোপ পড়তে পারে বলে আশঙ্কা এলাকাবাসীর।
নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ধানমন্ডি ২৭ নম্বরেও একইভাবে সড়কের মাঝের গাছ কাটার মহোৎসব দেখেছিলাম। হস্তক্ষেপের পর তখন দেখা গেল, গাছ রেখেও সংস্কারকাজ করা সম্ভব। পরে ২৭ নম্বরে অনেক গাছ বাঁচানো গিয়েছিল।
এ নিয়ে ডিএসসিসির বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (দ্বিতীয় সংশোধিত) পরিচালক মো. খায়রুল বাকের বলেন, কিছু করতে গেলে কিছু বিসর্জন দিতেই হয়। এই ডিভাইডার এখন বড় করছি। নতুন ডিভাইডারের মধ্যে সুন্দর করে যতটুকু সম্ভব হয় আমরা সবুজায়ন করে দেব। রাস্তার মাঝে ও দু’পাশে আগে অপরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো হয়েছে। যে কারণে ঝড়বৃষ্টি হলেই গাছ উপড়ে পড়ত। আমরা এখন ফুলসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগাচ্ছি। যেখানে যে গাছ টিকবে, সেগুলোই লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছি।
তিনি বলেন, ট্রাফিক ও সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সাতমসজিদ সড়কে এত ক্রসিং রাখা যাবে না। যেখানে প্রয়োজন, সেখানে শুধু ক্রসিং থাকবে। এখন প্রতিটি মোড়ে ক্রসিং, এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
কমছে সবুজ, বাড়ছে তাপমাত্রা
এ মৌসুমে রাজধানীতে তাপ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। টানা ২২ দিন বৃষ্টিহীন ছিল নগরী। এরপর মাঝে বৃষ্টি হলেও কমেনি গরমের অস্বস্তি। গরমে হাঁসফাঁসের পেছনে নগরীর গাছপালা কমে যাওয়াকে দুষছেন পরিবেশবিদরা।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) ২০২০ সালের জরিপে জানিয়েছে, ১৯৯৯ সালে ঢাকার কেন্দ্রীয় এলাকায় সবুজ ও খোলা জায়গার পরিমাণ ছিল ২১ শতাংশ। ক্রমে তা কমে ২০২০ সালে ঢাকার সবুজ এলাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ শতাংশ। বর্তমানে তা সাড়ে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং আইপিডির নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ২০২০ সালের পর প্রচুর উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সেই প্রকল্পগুলো সবুজকে ধ্বংস করেই করা হচ্ছে।
সরকারি সংস্থাই দায়ী
ছাদবাগানে উৎসাহী করতে ১০ শতাংশ কর ছাড়ের ঘোষণা আছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি)। অথচ সরকারি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধেই আছে বৃক্ষ রক্ষায় উদাসীনতার অভিযোগ।
মহাখালী থেকে গুলশান ১ নম্বর পর্যন্ত সড়ক, নর্দমা ও ফুটপাত উন্নয়নকাজে সড়কজুড়ে বিভাজক উঁচু করা হচ্ছে দেয়াল দিয়ে। এ জন্য সেখানে বিভাজকের বিভিন্ন জায়গায় কেটে ফেলা হয়েছে গাছ।
মহাখালী থেকে বনানী সড়কের পাশের সবুজ বেষ্টনীর গাছপালা কেটে মহাখালীতে করা হয়েছে অস্থায়ী বাজার। সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, সড়ক ও জনপথের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় করতে গিয়েও কাটা হয়েছে গাছ। বিমানবন্দর সড়ক ধরে বনানীর কাকলী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের দু’পাশের গাছপালা কেটে ‘সৌন্দর্যবর্ধন’ করা হয়েছে। মেট্রোরেলের জন্য বেগম রোকেয়া সরণি, আগারগাঁও, শ্যামলী শিশুমেলা এলাকায় সড়কের বিভাজকের জন্য কাটা পড়ে গাছ। বিআরটি প্রকল্পের জন্যও উত্তরায় গাছ কাটা পড়ে।
রাজধানীর ওসমানী উদ্যান একসময় ছিল সবুজে ঘেরা। বিকেলে শোনা যেত পাখির কিচিরমিচির। সেখানে গত কয়েক বছরে উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অসংখ্য গাছ কেটে পাকা স্থাপনা করা হয়েছে। উদ্যানটিতে অনেক দিন ধরেই সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। একইভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্কের উন্নয়ন করতে গিয়েও কাটা হয়েছে গাছ।
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার আনোয়ার পার্কে গাছ কেটে এখন মেট্রোরেলের মালপত্র রাখার স্থান করা হয়েছে। একইভাবে আজিমপুরের সরকারি কলোনিগুলোর ফাঁকে একসময় প্রচুর গাছপালা ছিল, সেগুলো কেটে বড় বড় অট্টালিকা হয়েছে। কল্যাণপুরে সরকারি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করতে গিয়েও কাটা হয়েছে অসংখ্য গাছ।
কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউর ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রাস্তার মাঝে যে ছোট ছোট গাছ ছিল, সেগুলো এখন আর নেই। শ্যামলী এলাকার রাস্তার মাঝে গাছ কেটে নিয়েছে ডিএনসিসি। কারওয়ান বাজারের পান্থকুঞ্জ পার্কেরও কিছু গাছ কাটা পড়ে। অন্যদিকে বিমানবন্দর থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত রাস্তায় একটি বেসরকারি সংস্থাকে গাছ লাগানোর দায়িত্ব দিয়ে সেখানে দেশীয় গাছের বদলে বিদেশি বনসাই গাছ লাগানো হলেও সেগুলো এখন বিলীন।
ঢাকার সবুজায়নে ভূমিকা রাখে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), দুই সিটি করপোরেশন এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। তবে ঠিক কতগুলো গাছ গত পাঁচ বছরে লাগিয়েছে, সেই পরিসংখ্যান নেই এসব সংস্থার কাছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রোড আইল্যান্ড বড় ও নিরাপদ করার নামে ডিএসসিসি যা করছে, তা উন্মত্ততা। বারবার গাছ লাগানো হবে আর নানা অজুহাতে কেটে আবার নতুন গাছ লাগানো হবে– এটা এক রকম বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। এ বাণিজ্য অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
এ ব্যাপারে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলামের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গত এপ্রিলে একটি জলাশয় পরিদর্শনে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কিছু সবুজ এলাকা আগেই নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে যেখানেই উন্নয়ন হচ্ছে, সেখানে গাছ রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। কোনো কারণে গাছ কাটা পড়লে আবার তা রোপণ করা হবে।
রাতে রাস্তায় প্রতিবাদ
সড়কদ্বীপ উন্নয়নের নামে সাতমসজিদ রোডে নির্বিচারে গাছ কাটার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে এলাকাবাসী। রাত সাড়ে ১০টার দিকে আবাহনী মাঠের পাশের সড়ক বিভাজকে আয়োজিত মানববন্ধনে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড নিয়ে ছুটে আসেন নারী ও শিশুরাও। কর্মসূচিতে যোগ দেন বিভিন্ন পরিবেশবিষয়ক সংগঠনের নেতারা।
মানববন্ধনে বক্তব্য দেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, অধিকারকর্মী খুশী কবির, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গবেষক পাভেল পার্থ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, সংস্কৃতিকর্মী অরূপ রাহী, লেখক মোস্তফা জামান, আর্ট অ্যান্ড মিউজিয়াম কিউরেটর আমিরুল রাজীব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আদনান আজিজ, গ্রিন ভয়েজের সমন্বয়ক আলমগীর কবির প্রমুখ।
সুলতানা কামাল বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য নগর বাঁচানো এবং নগরপিতাকে তাঁর দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
খুশী কবির বলেন, রাতের অন্ধকারে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে গাছ কাটা মেনে নেওয়া যায় না।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, যে সিটি করপোরেশন গাছের মর্ম বোঝে না, গাছের মূল্য বোঝে না, সেই সিটি করপোরেশন আমাদের না।
গাছ কাটা বন্ধ না হলে আজ বুধবার থেকে প্রতিদিন লাগাতার প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হবে বলে মানববন্ধন থেকে জানানো হয়।