ক্ষমতাসীন দলের যেসব নেতা বিএনপি আন্দোলন করতে পারছে না বলে এত দিন উপহাস করে আসছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এখন দলটির শক্তি ও জনপ্রিয়তা টের পাচ্ছেন।
এক সপ্তাহের কম সময়ের ব্যবধানে ঢাকায় তিনটি বড় কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বেশ উজ্জীবিত। বলা যায়, তাঁরা এখন সমুখযুদ্ধে। যদিও ২৯ জুলাইয়ে ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে আশানুরূপ লোকসমাগম করতে পারেনি দলটি। চারটি স্থানের মধ্যে মাতুয়াইলেই বিএনপির কর্মীরা কয়েক ঘণ্টা পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থান নিতে পেরেছে, কখনো কখনো পুলিশকে পিছু হটতেও বাধ্য করেছে। গাবতলী, উত্তরা ও ধোলাইখাল এলাকায় তাদের উপস্থিতি ছিল নিরুত্তাপ।
২৯ জুলাইয়ের কর্মসূচি দেখে মনে হয় তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিটি আর শান্তিপূর্ণ থাকছে না। পদযাত্রা, সমাবেশ, মহাসমাবেশের সঙ্গে অবস্থান কর্মসূচির মৌলিক পার্থক্য আছে। সমাবেশ ও পদযাত্রা সারা দেশের জনজীবনে তেমন প্রভাব ফেলে না। সরকারকেও চ্যালেঞ্জ করে না। ঢাকার সব প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি নেওয়ায় রাজধানীর সঙ্গে দেশের অন্যান্য এলাকার যোগাযোগ কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হয়।
সর্বস্তরের মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন কয়েক ঘন্টার জন্য। বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি সফল না বিফল, সেই বিতর্কের চেয়েও বড় কথা হলো, তারা এ রকম একটি মারমুখী কর্মসূচি নিতে পেরেছে। এটি সরাসরি সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছিল। দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি ধাপে ধাপে আন্দোলনকে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে যেতে চায় এবং সে জন্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আগস্টে নেতা-কর্মীরা মাঠে থাকলেও কঠোর কর্মসূচি নেবে না। সেপ্টেম্বরে হবে ফাইনাল খেলা।
অবস্থান কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি দেখাতে চেয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা বেপরোয়া ও মারমুখী আচরণ করতে পারে। প্রায় প্রতিটি স্থানে পুলিশ ও সরকারি দল পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে বলেছেন, ‘আপনাদের লোকজন কোথায়? তাঁরা আসেননি কেন?’
বিএনপি ২৮ জুলাইয়ের মহাসমাবেশ থেকে যখন ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়, তখনো আওয়ামী লীগ এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বলে মনে হয় না। বিএনপির দেখাদেখি তারাও প্রথমে একই স্থানে শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এরপর ডিএমপি থেকে অবস্থান কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো হলে আওয়ামী লীগ আগের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে। কিন্তু বিএনপি সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ঢাকার প্রবেশমুখে বেলা ১১টা থেকে ৫ ঘণ্টার ‘অবস্থান’ কর্মসূচি দেয়। বিএনপির কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ বলা হলেও নেতা-কর্মীদের মনোভাব ছিল, ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই।’
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, শনিবার বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে প্রতিটি প্রবেশপথে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। মাতুয়াইলে দুই পক্ষের সংঘর্ষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আহত হন। মাতুয়াইলে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশি পাহারার মধ্যে কীভাবে তিন যুবক মোটরসাইকেলে এসে বাসে আগুন লাগিয়ে গেল, সেটাও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজটি কি আন্দোলনকারীদের কেউ করেছে, না তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিয়েছে। সংঘাতের রাজনীতিতে দৃশ্যমান পক্ষের বাইরে অদৃশ্যমান নানা পক্ষ থাকে।
ধোলাইখালে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রথমে পুলিশের ধাওয়ায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা পিছিয়ে যান। পরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সংগঠিত হয়ে পুলিশকে ধাওয়া দেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে নিয়ে যাওয়ার আগে তাঁকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে পুলিশ। একপর্যায়ে তিনি মাটিতে পড়ে যান। সে অবস্থায়ও তাঁকে লাঠিপেটা করা হয়। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি পুলিশ কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদ সোনারগাঁও থেকে খাবার আনিয়ে মধ্যাহ্নভোজও করিয়েছেন। পরে ডিবির গাড়িতেই তাঁকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একজন নেতাকে মাটিতে ফেলে বেধড়ক পিটিয়ে তাঁকেই আবার ডিবি অফিসে রাজসিক আপ্যায়নের রহস্য জানা গেল না।
গাবতলীতে বিএনপির কর্মসূচিকে পুলিশ বাধা দিলে দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ তাদের সরে যেতে বললে আমানউল্লাহ জায়গা ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। ডাকসুর সাবেক ভিপি আমানউল্লাহও পুলিশের আঘাতে আহত হন। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে পুলিশ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনি বর্তমানে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন। গাবতলীতেও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে উত্তরার আবদুল্লাহপুর বিএনএস সেন্টার এলাকায় অবস্থান নেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনার পর ময়মনসিংহের বিভিন্ন রুটের বাস মহাখালী বাস টার্মিনালে আসছে, কিছু বাস ছেড়েও যাচ্ছে। তবে যাত্রী অন্য সময়ের তুলনায় কম। ময়মনসিংহ রুটের সৌখিন পরিবহনের চালকের সহকারী আহমেদ আলী বলেন, ‘গাড়ি ছাড়ছি। কিন্তু যাত্রী নাই, পুরাই ফাঁকা। সামনে গেলে দেখি কিছু যাত্রী পাই কি না।’
বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ৩০ জুলাই সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়েছে। বিএনপিও সরকারের দমনপীড়নের প্রতিবাদে সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে সমাবেশ ডেকেছে। এরপর বিএনপির কর্মসূচির প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ আবার কর্মসূচি নেবে। তার প্রতিবাদে বিএনপি কর্মসূচি নেবে। এভাবে একের পর এক কর্মসূচি চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতির কী হাল হবে? জনজীবনের নিরাপত্তা কোথায় থাকবে?
সরকারকে বুঝতে হবে নির্বাচনকেন্দ্রিক সমস্যাটি পুরোপুরি রাজনৈতিক। আইনশৃঙ্খলাজনিত নয়। আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা পুলিশ-র্যাব-বিজিবি দিয়ে মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে রাজনৈতিকভাবেই। তারা বুঝতে পারছেন না নির্বাচনের বিষয়ে দুই দলের বিপরীত অবস্থান দেশকে মহা অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সংবিধান পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু অপরিবর্তিত সংবিধানের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করতেও যেসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, সেটা কি তাঁরা নিয়েছেন? প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছে বা করার কোনো সুযোগ আছে?
অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা শান্তি বিনষ্ট করেছেন বলে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করেছে। তাদের দলের নেতা-কর্মীরা রাস্তায় রবীন্দ্র সংগীত গাইতে নামেননি। বিএনপির মহাসমাবেশ ও পদযাত্রায় কোনো অশান্তি ঘটেনি। কেউ পুলিশকে লক্ষ্য করে একটি ঢিলও ছোড়েনি। তারপরও কেন পুলিশ মহাসমাবেশে আসা নেতা-কর্মীদের (এমনকি সাধারণ মানুষও) তল্লাশি করল? কেন তাঁদের মুঠোফোন চেক করা হলো? নির্বাচনের সময়েও যে তাঁরা একই কাজ করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?
২৯ জুলাইয়ের কর্মসূচির দিনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপির নেতা আমানউল্লাহ আমানের জন্য খাবার, ফল ও ফলের রস পাঠানো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিনিধিরা এই খাবার ও ফল বিএনপির নেতার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সেই ছবি সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। টিভিতেও দেখানো হয়েছে। আমানউল্লাহ আমান অবশ্য এটাকে নাটক ও তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষু্ন্ন করার প্রয়াস বলে অভিহিত করেছেন।
গত বছর ১০ ডিসেম্বর বিএনপির কর্মসূচিকে ঘিরে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমানউল্লাহ আমান ছিলেন সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ। আমানউল্লাহ আমান বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ খালেদা জিয়ার কথায় চলবে। গয়েশ্বর সব সময়ই সরকারের বিরুদ্ধে চড়া গলায় কথা বলেন। ২৯ জুলাই পুলিশ কর্মকর্তা নুরুন্নবী বলেছেন, তাঁর নির্দেশেই পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। যার নির্দেশে পুলিশের ওপর হামলা হলো, তাঁকেই ডিবি অফিসে নিয়ে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন! দুই ঘটনার রহস্য খুঁজতে আরও কোনো রহস্য বের হবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। আন্দোলন, বিক্ষোভ, পাল্টা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দেশ এখন আরও অনিশ্চয়তার পথে চলে গেছে তাতে সন্দেহ নেই।
- সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি
ইমেইল: sohrab.hassan@prothomalo.com