ইসি কতটা ‘কঠোর’, সেই পরীক্ষা হচ্ছে না

0
141
নির্বাচন কমিশনের (ইসি)

বরিশাল ও খুলনা সিটিতে গাজীপুরের চেয়ে ভালো নির্বাচন করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই দুই সিটিতে ভোট আগামীকাল।

২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারা। তখন মামলা, গ্রেপ্তার, হুমকিসহ নানা কৌশলে ভোটের আগেই বিএনপির নেতা-কর্মীদের মাঠছাড়া করার অভিযোগ উঠেছিল। ইসি ছিল দর্শকের ভূমিকায়। বিএনপি এবার সিটি নির্বাচনে নেই, ফলে ইসিকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরীক্ষায় পড়তে হয়নি।

নির্বাচন বিশ্লেষকেরা বলছেন, আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভোটের মাঠে না থাকায় সিটি নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটের আসল চ্যালেঞ্জ ইসিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে না। সব দলের অংশগ্রহণে যদি আগামী জাতীয় নির্বাচন হয়, সেখানে ইসি আসলে কতটা শক্ত অবস্থান নিতে পারবে, সেই ধারণা এবারের সিটি নির্বাচন থেকে পাওয়া যাবে না।

এবার সিটি নির্বাচনের ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশনে গাজীপুর সিটির (২৫ মে অনুষ্ঠিত) চেয়ে ভালো নির্বাচন করতে চায় সাংবিধানিক এই সংস্থা। আগামীকাল সোমবার এই দুই সিটি করপোরেশনে ভোট গ্রহণ করা হবে।

■ সিটি নির্বাচনে ইসির কাছে এখন পর্যন্ত মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ‘গোপন বুথের ডাকাত’ ঠেকানো।

■ বিএনপি এবার সিটি নির্বাচনে নেই, ফলে ইসিকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরীক্ষায় পড়তে হয়নি।

■ কোন প্রার্থীর জন্য গত বছর গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়ম করা হয়েছিল, ইসির তদন্তে তা উঠে আসেনি।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত বেশির ভাগ নির্বাচন হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। অনেকটা একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত এসব নির্বাচনেও ছিল নানা অভিযোগ। বিশেষ করে গোপন বুথে অবৈধ ব্যক্তিদের অবস্থান নিয়ে অন্যের ভোট দিয়ে দিতে দেখা গেছে। ভোট দেওয়ার ‘গোপন বুথে ডাকাত দেখে’ গত বছরের অক্টোবর মাসে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করা ছিল ইসির বড় পদক্ষেপ। কিন্তু কোন প্রার্থীর জন্য গাইবান্ধার ভোটে অনিয়ম করা হয়েছিল, ইসির তদন্তে তা উঠে আসেনি। প্রার্থী, স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের ব্যাপারেও কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সিটি নির্বাচনে ইসির কাছে এখন পর্যন্ত মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ‘গোপন বুথের ডাকাত’ ঠেকানো। ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনাররা একাধিকবার নির্বাচনী এলাকা সফর করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্টদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ভোটের গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, বিষয়টি নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বলা হয়েছে, কেউ অনিয়ম করলে বা অনিয়মে সহায়তা করলে তাঁদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবৈধভাবে কেউ বুথে অবস্থান করতে গেলে তাঁদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বরিশাল ও খুলনায় যাতে প্রচারের সময় শেষে কোনো বহিরাগত নারী-পুরুষ নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করতে না পারেন, সে জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেন, ‘নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমাদের নির্দেশনা প্রশাসন, পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা শতভাগ পালনের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আমাদের বার্তা স্পষ্ট, আমরা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করেছি, নির্বাচন প্রচারণায় অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলা করলে কোনো ধরনের ছাড় দিইনি।

বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধের জন্য চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। বরিশাল ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন গাজীপুরের নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে বলে বিশ্বাস করি। অনিয়মের সঙ্গে কেউ জড়িত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে অতীতের চেয়ে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আমাদের বার্তা স্পষ্ট, আমরা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করেছি, নির্বাচন প্রচারণায় অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলা করলে কোনো ধরনের ছাড় দিইনি।

নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান

আহসান হাবিব বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচনে বিধিবিধান প্রতিপালনে আমাদের অবস্থান কঠোর ছিল। খুলনা ও বরিশাল সিটি নির্বাচনের প্রতিটি পদক্ষেপই আমরা সুতীক্ষ্ণ নজরে রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। ভোটের দিনও আমরা সরাসরি সিসিটিভি ক্যামেরায় এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করব।’

২০১৪, ২০১৮ সালের নির্বাচনসহ গত এক দশকে বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের বেশির ভাগ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ছিল। নির্বাচন বিশ্লেষকেরা বলে আসছেন, দেশের নির্বাচনী পরিবেশ অনেকটা ধ্বংস হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল ও মানুষের আস্থা নেই। এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেয় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন। তবে এবারের সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি নেই। বর্তমান ইসির অধীনে এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে দলটি অংশও নেয়নি। ফলে এখন পর্যন্ত বর্তমান কমিশনকে খুব বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন পরিচালনা করতে হয়নি। বর্তমান ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর গত এক বছরের বেশি সময় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক ও প্রশ্ন উঠেছে।

এসব নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থীও নেই। তাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচনের ধারণা পাওয়া যাবে না। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রদবদল হবে।

সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার

গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে প্রশংসা পেয়েছিল ইসি। ওই নির্বাচনে সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচন হন। সামনে বরিশাল, খুলনা, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এই চার সিটিতেও বিএনপি ভোটে নেই। তবে বরিশাল ও সিলেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। খুলনা ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা কম।

সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গাজীপুরের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কারণ, সেখানে ক্ষমতাসীন দল তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। যে কারণে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে বল বা চাপ প্রয়োগের বিষয়টি দৃশ্যত দেখা যায়নি। সামনে বরিশাল সিটি নির্বাচনে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। বাকি তিন সিটিতে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে বলেই মনে হচ্ছে, কিন্তু গ্রহণযোগ্য হবে না। এসব নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থীও নেই। তাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচনের ধারণা পাওয়া যাবে না। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রদবদল হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.