তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত কত দিন

0
90
হাইকোর্ট

দুর্নীতি ও গুরুতর পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগে ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত তিন বিচারপতিকে বিচারিক দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এই সিদ্ধান্ত দেন। অথচ ওই তিন বিচারপতি বিচারকাজে না থেকেও গত চার বছর বেতন-ভাতা, আবাসন, যানবাহনসহ আনুষঙ্গিক সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।

তারা হলেন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক। অব্যাহতি দেওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল, তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপিল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি (বর্তমানে অবসরে) মো. ইমান আলীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল তদন্ত কমিটি। কিন্তু এরপর চার বছর কেটে গেলেও তাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

জানা গেছে, তিন বিচারপতি বিচারিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর কিছুদিন ছুটিতে ছিলেন। পরে আর তারা ছুটি নেননি। মাঝেমধ্যে তারা সুপ্রিম কোর্টে তাদের জন্য নির্ধারিত অফিসকক্ষে আসেন এবং কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে চলে যান। চাকরিবিধি অনুযায়ী, বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ২০২৫ সালের ২৮ নভেম্বর এবং বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক ২০২৬ সালের ৩১ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার কথা।

বিধি অনুযায়ী এই বিচারপতিদের জন্য ২৭ জন সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা। অবশ্য তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ইতোমধ্যে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। তিন বিচারপতির বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের জন্য গত চার বছরে রাষ্ট্রের প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

চাকরিবিধি অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতির ৯৫ হাজার টাকা মূল বেতন, বাড়ি ভাড়া, অন্যান্য ভাতাসহ সর্বমোট প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। এর সঙ্গে অবারিত চিকিৎসা ভাতা, টেলিফোন বিলসহ আরও কিছু সুবিধা পান। এ ছাড়া একজন বিচারপতির সঙ্গে জনবল সুবিধা থাকে।

সূত্র জানায়, বিধিবহির্ভূতভাবে অধস্তন আদালতের মামলায় হস্তক্ষেপ করে ডিক্রি পাল্টে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহুরুল হকের বিরুদ্ধে। তারা হাইকোর্টে একটি দ্বৈত বেঞ্চে দায়িত্ব পরিচালনা করতেন। বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলায় অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে।

বিচারপতিদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার (জেলা জজ) মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘স্পর্শকাতর বিষয়। তদন্তের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।’ এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন নিষ্পত্তি হলেই তিন বিচারপতির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘বিয়ষটির সুরাহা হওয়া উচিত। সময় হলে সবই হবে। অপেক্ষা করেন।’

সুপ্রিম কোর্টের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বিচারপতি অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আপিল বিভাগের রায়ে বাতিল হওয়ায় কোন প্রক্রিয়ায় অপসারণ করা হবে, তা নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ে মতভেদ রয়েছে। একই সঙ্গে তদন্ত প্রক্রিয়া নির্ধারণ নিয়েও মতভেদ আছে। এ জন্য তাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলা আপিল বিভাগের রায়ে বাতিল হওয়ার পর বিচারপতির অপসারণের জন্য এখন সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হয়েছে। অভিযুক্ত তিন বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নিতে হলে সেটা সংবিধানসম্মত উপায়ে নিতে হবে। আর যদি সেটা নিতে হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে হবে।’

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কার্যক্রম প্রসঙ্গে শাহ্‌দীন মালিক বলেন, এই প্রক্রিয়া অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পরবর্তী দু’জন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হবে। তারা অভিযুক্ত তিন বিচারপতির কাছে অভিযোগের বিষয়ে জবাব চাইবেন। পরে প্রয়োজনে তাদের সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করবেন। এর আলোকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যদি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগের বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে মতামত পাঠাবেন। এরপর রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত কার্যকর করবেন।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ আবেদন বর্তমানে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। বৃহস্পতিবার আবেদনটি কার্যতালিকার ৪১ নম্বরে ছিল। জানতে চাইলে ষোড়শ সংশোধনী মামলার জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ আবেদন বিচারাধীন। কিন্তু আপিল বিভাগের রায় স্থগিত হয়নি। তাহলে বাধা কোথায়? রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি না হলেও সরকার চাইলে তিন বিচারপতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর রয়েছে।

তাঁর মতে, তিন বিচারপতিরও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ না করা বা কাজে ফেরা বা অপসারণের বিষয়ে ঝুলিয়ে রাখাটা আইনের শাসনের পরিপন্থি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.