ইউরোপ কি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়া ইউক্রেনে শান্তি নিশ্চিত করতে পারবে

0
10
ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আলোচনা করতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্দোনিও কস্তা, ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মিতে ফ্রেডরিকসেন, সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসন, নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জোনাস গাহর স্টোর, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার স্টাবসহ বিভিন্ন দেশ ও জোটের নেতারা লন্ডন সম্মেলনে অংশ নেন। রোববার, লন্ডনের ল্যানচেস্টার হাউসে, ছবি:

হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বৈঠকটি কিয়েভের জন্য বিপর্যয়কর হয়েছে। এরপর ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে জেলেনস্কিকে নিয়ে একটি শান্তি পরিকল্পনা তৈরির চেষ্টা করছে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার রোববার এই ঘোষণা দেওয়ার পর প্রশ্ন উঠছে যে রাশিয়ার অব্যাহত শত্রুতা ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে ইউক্রেনে শান্তি কি আসলে সম্ভব এবং হলেও তা কী কী শর্তে হতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কি শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব?

ইউক্রেন ও রাশিয়া দুই দেশই যুদ্ধ শেষ করার কথা বললেও দেশগুলো এখনো চুক্তিতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে অনেক দূরত্বে অবস্থান করছে।

ক্রেমলিন এখনো ইউক্রেনের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। রাশিয়া ইউক্রেনের বিপুল এলাকা দখল করে আছে। ইউক্রেন যেন ন্যাটোতে যোগ দিতে না পারে সেটা তাদের চাওয়া। অন্যদিকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়ছে ইউক্রেন এবং তারা পশ্চিমা পরিসরে নিজেদের স্বাধীন ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চায়। পরিস্থিতি নিয়ে লন্ডনের কিংস কলেজের ইমেরিটাস অধ্যাপক স্যার লরেন্স ফ্রিডম্যান বলেন, ‘আমি মনে করি, রাশিয়া যা চায়, সেটা যুক্তরাষ্ট্র দিতে পারে না এবং ইউক্রেন সেটা মেনে নেবে না।’

ইউক্রেন যদিও ইঙ্গিত দিয়েছে যে বর্তমানে যেসব জায়গায় যুদ্ধ চলছে সেসব জায়গা ধরে রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত ভাগাভাগি তারা মেনে নিতে পারে, তারপর তাদের জন্য আরও বেদনাদায়ক কোনো শর্ত মেনে নেওয়ার চেয়ে দেশটি লড়াই চালিয়ে যেতে চাইবে। ইউক্রেনের বেশির ভাগ মানুষ রাশিয়ার প্রভাবের অধীন থাকতে চায় না। রাশিয়ার আধিপত্য প্রতিরোধ করার আকাঙ্ক্ষা ইউক্রেনের সমাজে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান।

যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ত্যাগ করলে কী ঘটবে?

ট্রাম্প ও জেলেনস্কির মধ্যে শুক্রবারের বৈঠকে ঘটে যাওয়া বাগ্‌বিতণ্ডার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ককে একটি খারাপ পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এত দিন রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সবচেয়ে বেশি সমরাস্ত্র সরবরাহ করা যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই সহায়তা বন্ধ করে দেবে কি না। বিগত বাইডেন প্রশাসনের অনুমোদন দিয়ে যাওয়া প্রায় চার বিলিয়ন ডলারের সহায়তা এখন ঝুলে আছে। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ওই সহায়তা বাতিল করা হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা বন্ধ করলে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি ইউক্রেনের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠবে, যদিও তার প্রভাব পড়তে কিছুটা সময় নেবে। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের অনুমান, যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁরা যেসব সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করছেন, তার প্রায় ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা। এই যুদ্ধে ইউক্রেন বাহিনীর যেসব সমরাস্ত্র সবচেয়ে কার্যকর হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সমরাস্ত্রগুলোই রয়েছে। সেগুলোর অভাব ইউরোপ বা অন্য কোনো জায়গা থেকে পূরণ করা সম্ভব নয়।

তবে ইউক্রেন বাহিনী যেহেতু আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিয়ে আছে, সে কারণে ২০২৪ সালে রুশ বাহিনীর অগ্রগতি ধীরে হয়েছে। রাশিয়ার পক্ষে হতাহতের হারও বেশি, প্রায়ই এক দিনে হাজারের বেশি হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ইউক্রেনের উল্লেখযোগ্য কোনো শহর বেদখল হয়নি। ইনস্টিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ারের হিসাবমতে, গত বছর রুশ বাহিনী যে গতিতে এগিয়েছে তাতে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে দোনেৎস্ক অঞ্চল রুশ বাহিনীর পুরোপুরি দখলে নিতে আরও দুই বছর লেগে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার ঘাটতি কি ইউরোপ মেটাতে পারে?

যুক্তরাষ্ট্র যেসব সমরাস্ত্র সরবরাহ করে এসেছে, সেগুলো ইউরোপ দেবে—এমনটা দেখাটা কঠিন হবে। অর্থাৎ ইউক্রেনের সামরিক পরিস্থিতি কঠিন হবে। লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক র‌্যাচেল এলেহুস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বিশেষ করে তিনটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো আকাশ প্রতিরক্ষা, যেখানে প্যাট্রিয়ট ব্যবস্থার বিকল্প ইউরোপে তেমন একটা নেই; দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, এ ক্ষেত্রে জার্মানি তাদের টরাস ক্ষেপণাস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আর ফ্রাঙ্কো–ব্রিটিশ স্টর্ম শ্যাডো ক্ষেপণাস্ত্রের সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে; এবং তৃতীয়ত, স্যাটেলাইট যোগাযোগ, যেখানে ইলন মাস্কের স্টারলিংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

এখানে যুদ্ধের ব্যয় চালানোর প্রশ্নও রয়েছে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য ৩৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সমরাস্ত্র কেনার জন্য ইউক্রেনকে আরও ৩৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে ওয়াশিংটন।

সেখানে ইউরোপীয় দেশগুলোর সামরিক সহায়তা খুব বেশি নয়। জার্মানির ইউনিভার্সিটি অব কিয়েলের হিসাবমতে, ইউরোপের দেওয়া এই সহায়তার পরিমাণ ৬২ বিলিয়ন ইউরো, যা ৬৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে সেই অভাব পূরণ করতে ইউরোপকে দ্বিগুণ অর্থ ঢালতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ইউরোপ কি ইউক্রেনে শান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারবে?

ইউক্রেনে শান্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইউরোপের নেতৃত্বে একটি বাহিনী গঠনের আলোচনা চললেও তার জন্য অন্তত যুদ্ধবিরতির দরকার হবে। রাশিয়া ইতিমধ্যে আপত্তি জানিয়ে বলেছে, ইউক্রেনে ন্যাটোর সদস্যদেশের শান্তিরক্ষীদের তারা মেনে নেবে না। অবশ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা ইউক্রেনের অন্যান্য অঞ্চলে এসব সৈন্য মোতায়েন করা হলে তা ঠেকাতে পারবে না মস্কো। কিন্তু দেশটিতে শান্তিরক্ষায় যাওয়া ওই সব সেনা ঝুঁকিতে থাকবেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, জেলেনস্কির হাতে ‘কার্ড নেই’। ইউক্রেনে কোনো বাহিনী পাঠালে, বিশেষ করে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য, সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যেন সমর্থন দেয়, সেই চেষ্টা করছে যুক্তরাজ্য। তবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার নিজেই ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে তেমন কোনো প্রতিশ্রুতি পাননি। এরপর শুক্রবার ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির ওই বাগ্‌বিতণ্ডার সেই সম্ভাবনা আরও কমে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির বিরুদ্ধে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলার’ অভিযোগ করেছেন।

যুক্তরাজ্যের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা লর্ড রিকেটস বলেছেন, ‘ইউরোপ কি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি পাচ্ছে? আমি তেমনটা মনে করি না।’

এর ফলে ন্যাটো ও আটলান্টিকের দুই পারের নিরাপত্তা জোটের কী হবে?

স্পস্ট বাস্তবতা এটাই যে কয়েক দশক ধরে ইউরোপীয় নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া চুক্তিটি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে অদৃশ্য হয়ে গেছে। ইউরোপ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে পেরেছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় পুরো ইউরোপ মহাদেশের ওপর ক্রমবিকাশমান নিরাপত্তা ছাতা প্রসারিত করেছিল। এখন ন্যাটোর বিষয়ে ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি অনিশ্চিত। এ পরিস্থিতিতে ইউরোপে অবস্থান করা লাখখানেক মার্কিন সেনার সবাই মহাদেশটিতে থাকবে কি না—তা স্পষ্ট নয়। সেই সঙ্গে হোয়াইট হাউস এখনো রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি নিরাপত্তা আলোচনা শুরু করতে আগ্রহী।

এলেহুস বলেন, ‘কিছুদিন ধরেই এটা স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য নিরাপত্তা বিষয় অগ্রাধিকারে রয়েছে। সেটা অভ্যন্তরীণ ও প্রশান্ত মহাসাগরে। সেখানে দেশটি চীনের কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদের চ্যালেঞ্জ দেখতে পাচ্ছে।’ এই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘ন্যাটোর মিত্ররা এটা এক দশক ধরে জেনে এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত, তারা পদক্ষেপ নেন এমন কিছুই ঘটেনি। ন্যাটো কি টিকে থাকবে? এটা কঠিন একটি প্রশ্ন।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.