সমুদ্র সৈকতের একটি অবকাশ কেন্দ্রে গড়ে তোলা হয়েছে প্রতিরক্ষা দুর্গ। প্রতিপক্ষের অগ্রসরমান ট্যাঙ্ক ঠেকাতে প্রধান একটি সড়ক ধরে খনন করা হয়েছে পরিখা। স্যাটেলাইট থেকে তোলা কিছু ছবি বিশ্লেষণ করে বিবিসির ভ্যারিফাই বিভাগ বলছে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ ঠেকাতে রাশিয়া এধরনের ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কয়েক মাসের অচলাবস্থার পর ধারণা করা হচ্ছে যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত এই আক্রমণ ইউক্রেনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হয়ে উঠতে পারে। কারণ এই পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে কিয়েভ প্রমাণ করতে চাইছে যে পশ্চিমাদের কাছ থেকে পাওয়া অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে তারা রণক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য রকমের বিজয় অর্জন করতে সক্ষম।
স্যাটেলাইট থেকে তোলা এরকম শত শত ছবি পরীক্ষা করে বিবিসি ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করেছে যেখানে রাশিয়া পরিখা খনন করাসহ অন্যান্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
১. ক্রাইমিয়ার পশ্চিম উপকূল
রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়া দখল করে নেয় যা একসময় সমুদ্র সৈকতে গড়ে ওঠা অবকাশ কেন্দ্রের জন্য সুপরিচিত ছিল। এখন এই দ্বীপের ১৫ মাইল দীর্ঘ উপকূলে রোদ-নিবারক ছাতা যেমন নেই, তেমনি নেই সূর্যস্নান করতে যাওয়া লোকজনও। তার পরিবর্তে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রুশ সৈন্যদের স্থাপিত প্রতিরক্ষা স্থাপনা।
নিচের ছবিতে ক্রাইমিয়ার পশ্চিম উপকূলে বালির একমাত্র খোলা সৈকতটি দেখা যাচ্ছে যেখানে পাহাড় অথবা উঁচু খাঁড়া ক্লিফের মতো প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই।
প্রথমত সৈকতের তটরেখা ধরে আছে ‘ড্রাগন্স টিথ।’ ড্রাগন্স টিথ হচ্ছে পিরামিড আকৃতির কংক্রিটের ব্লক। ট্যাঙ্কসহ অন্যান্য সামরিক যানের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার জন্য এসব ব্লক ব্যবহার করা হয়।
তার পেছনেই আছে এক সারি পরিখা যা প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে সৈন্যদের রক্ষা করবে। দীর্ঘ এই পরিখার বিভিন্ন স্থানে কিছু বাঙ্কারও দেখা যায়।
এছাড়াও আছে কাঠের স্তূপ, খনন করার যান এবং ড্রাগন্স টিথের মজুত। এসব দেখে ধারণা করা যায় যে উপকূলজুড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ এখনও চলছে।
স্যাটেলাইট থেকে এসব ছবি তোলা হয়েছে গত মার্চ মাসে।
কোনো কোনো সামরিক বিশেষজ্ঞ বলছেন রাশিয়া সতর্কতা হিসেবেই সেখানে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলছে বলে তারা ধারণা করছেন। এর অর্থ এই নয় যে রাশিয়া সমুদ্রপথে আসা কোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে সেখানে এসব স্থাপনা বসিয়েছে। কারণ ইউক্রেনের নৌ ক্ষমতা খুবই সীমিত।
তবে গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষক লায়লা গেস্ট বলছেন: ‘স্থলপথে নয় বরং সমুদ্রপথে ক্রাইমিয়ায় ইউক্রেনের আক্রমণ প্রতিহত করতেই সম্ভবত এসব প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করা হয়েছে।’
২. টকমাক
ইউক্রেনের ছোট্ট একটি শহর টকমাক যা দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ একটি পথের মধ্যে পড়ে। রাশিয়ার দখল করে নেওয়া অন্যান্য অঞ্চল থেকে ক্রাইমিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ইউক্রেনীয় সৈন্যরা এই শহরটিকে ব্যবহার করতে পারে।
খবরে জানা যাচ্ছে এই শহরটিকে একটি সামরিক দুর্গে পরিণত করার লক্ষে সেখান থেকে বেসামরিক ইউক্রেনীয় নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এর ফলে সৈন্যদের কাছে রসদ সরবরাহ করা যাবে এবং একই সাথে প্রয়োজনের সৈন্যরা পিছু হটে এই ঘাঁটিতে এসে অবস্থান নিতে পারবে।
স্যাটেলাইট থেকে তোলা উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে টকমাক শহরের উত্তরে দুটো রেখায় পরিখা নেটওয়ার্ক খনন করা হয়েছে। ইউক্রেনীয় বাহিনী এই দিক থেকে রুশ সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে।
এসব পরিখার পেছনে এই শহরের চারপাশ ঘিরে আরো কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। এসব প্রতিরক্ষার ব্যূহের রয়েছে তিনটি স্তর যা নিচের ক্লোজ-আপ স্যাটেলাইট ছবিতে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
এই স্যাটেলাইট ছবির উপরের দিকে দেখা যাচ্ছে ট্যাঙ্ক-প্রতিরোধী পরিখা। এগুলো সাধারণত আড়াই মিটার গভীর। শত্রুপক্ষের কোনো ট্যাঙ্ক এগুলো পার হয়ে আসার চেষ্টা করলে এসব পরিখার মাধ্যমে ট্যাঙ্কগুলোকে আটকে দেওয়া হয়।
এই পরিখার পেছনে আছে ড্রাগন্স টিথের আরো কয়েকটি সারি। এবং তারপরে পরিখার আরো একটি নেটওয়ার্ক।
কিন্তু ইউক্রেনীয় বাহিনীকে আরো কিছু ফাঁদের মুখে পড়তে হতে পারে।
টকমাক শহরের তিনটি প্রতিরক্ষা স্তরের মধ্যবর্তী স্থানে স্থল-মাইন লুকিয়ে রাখার সম্ভাবনাও অনেক বেশি- বলছেন সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মার্ক ক্যানসিয়ান।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই সাধারণত মাইনফিল্ড থাকে, আর রাশিয়া তো পুরো যুদ্ধজুড়েই ব্যাপকভাবে মাইন ব্যবহার করে আসছে। এখানে মাইনফিল্ড আরো বড় হবে এবং এগুলো হয়তো আরো বেশি গোপন। তাদের উদ্দেশ্য ইউক্রেনীয় সৈন্যদের আক্রমণের গতি শ্লথ করে দেওয়া যাতে রাশিয়ার পদাতিক ও গোলন্দাজ বাহিনী আক্রমণকারী বাহিনীর ওপর হামলা চালাতে পারে।’
৩. E105 মহাসড়ক
স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে টকমাক শহরের পশ্চিম দিকে E105 প্রধান মহাসড়কের পাশ দিয়ে ২২ মাইল দীর্ঘ ট্যাঙ্ক-প্রতিরোধী পরিখা দেখা যাচ্ছে।
এই E105 মহাসড়ক কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই সড়কটি ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে রাশিয়ার দখল করে নেওয়া মেলিটোপল শহরকে উত্তরের খারকিভ শহরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। খারকিভ এখনও ইউক্রেনীয় সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণে।
এই সড়কটি যে পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করবে তাদের সৈন্যরা এই অঞ্চলে ও তার আশেপাশে সহজে চলাচল করতে পারবে।
ইউক্রেনীয় বাহিনী যদি এই সড়ক ব্যবহারের চেষ্টা করে, রাশিয়া তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহের পেছন থেকে ভারী কামান দিয়ে শত্রুপক্ষের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। পাশের আরো একটি সড়ক T401 মহাসড়কের আশেপাশেও রাশিয়ার অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।
বলেন ক্যানসিয়ান, ‘ইউক্রেন সম্প্রতি যেসব সামরিক ইউনিট গড়ে তুলেছে সেগুলোর বিষয়ে রাশিয়ার উদ্বেগ রয়েছে। এসব ইউনিট যদি প্রধান মহাসড়কে উঠে পড়তে পারে, তাহলে তারা খুব দ্রুত অগ্রসর হতে পারবে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য হচ্ছে এসব ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সড়কে উঠতে না দেওয়া এবং এভাবেই তাদের গতি কমিয়ে দেওয়া সম্ভব।’
৪. রিভনোপিল, মারিউপোলের উত্তরে
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার দখল করে নেওয়া অঞ্চল এবং দক্ষিণের ক্রাইমিয়ার মাঝখানে অবস্থিত মারিউপোল বন্দরের অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও ইউক্রেনীয় সৈন্যরা শহরটির পতনের আগে কয়েক মাস ধরে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারার কারণে এটি তাদের প্রতিরোধের প্রতীকেও পরিণত হয়েছে।
রাশিয়া মনে করছে ইউক্রেন হয়তো এখন এই শহরের পুনর্দখল নেওয়ার চেষ্টা চালাতে পারে। বিবিসি ভেরিফাই বিভাগ এই শহরের আশেপাশের এলাকা দেখার চেষ্টা করলে সেখানে কয়েকটি বৃত্তাকার পরিখার সন্ধান পাওয়া যায়।
মারিউপোলের ৩৪ মাইল উত্তরে ছোট্ট একটি গ্রাম রিভনোপোলে এসব পরিখা খনন করা হয়েছে। এগুলোর মাঝখানে মাটির স্তূপ। সম্ভবত কামান রক্ষা কিম্বা কামানের বন্দুক স্থিতিশীল রাখার জন্য মাটির এই স্তূপ বসানো হয়েছে।
এছাড়াও শত্রুপক্ষের আক্রমণের মুখে সৈন্যরা এসব বৃত্তাকার পরিখায় আশ্রয় নিতে পারবে এবং তাদের কামান সরিয়ে নিতে পারবে। এসব পরিখা থেকে তারা যে কোনো দিকে আক্রমণ করতে পারবে।
স্যাটেলাইটের ছবি থেকে বোঝা যাচ্ছে যেসব জায়গায় পাহাড় ও নদীনালার মতো প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই, রাশিয়া সেসব খোলা জায়গাকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তবে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন ইউক্রেনীয় বাহিনীও একই ধরনের স্যাটেলাইট ছবি ও ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়ার এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করতে পারে।