
গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পাঠানো এক আলোচনাকারীর সঙ্গে খাবার খাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বৈঠক করেন স্টিভ উইটকফ। মস্কোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় নেতৃত্বদানকারী বিশেষ মার্কিন দূত তিনি। ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে উইটকফ একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন।
উইটকফ মনে করেন, ইউক্রেনের পূর্বদিকের চারটি অঞ্চলকে নিজেদের মালিকানায় আনতে রাশিয়া যে কৌশল নিয়েছে, তাকে সমর্থন দেওয়াটাই ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার একটি দ্রুততম উপায়। দুই মার্কিন কর্মকর্তা এবং ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও পাঁচ ব্যক্তি রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন। ২০২২ সালে ইউক্রেনের ওই চার অঞ্চলকে রাশিয়া অবৈধভাবে নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা চালিয়েছিল।
এর আগেও উইটকফ একই ধরনের মনোভাব জানিয়েছিলেন। এমনকি গত মাসে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব টাকার কার্লসনকে দেওয়া একটি পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে প্রকাশ্যে তিনি এমন অভিমত জানিয়েছিলেন। তবে ইউক্রেন বারবারই এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের কেউ কেউ একে মূলত রাশিয়ার দাবি বলে উল্লেখ করেছেন।
ইউক্রেনে নিযুক্ত মার্কিন দূত জেনারেল কিথ কেলোগ ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে উইটকফের বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন বিবাদপূর্ণ ভূমিসংক্রান্ত কিছু শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছুক হলেও রাশিয়ার কাছে একতরফাভাবে অঞ্চলগুলোর সম্পূর্ণ মালিকানা হস্তান্তরে কখনোই রাজি হবে না। সংশ্লিষ্ট দুটি সূত্র এ কথা জানিয়েছে।
বৈঠকে মার্কিন কৌশল বদলানোর বিষয়ে ট্রাম্প কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। তাঁর সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠকটি শেষ হয়। গতকাল শুক্রবার পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে রাশিয়ায় সফর করেন উইটকফ।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে অচলাবস্থা কীভাবে ভাঙা যাবে, তা নিয়ে উইটকফের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতবিরোধ ক্রমাগত বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন কেলোগ। তিনি চান, ইউক্রেনকে আরও বেশি সরাসরি সমর্থন দেওয়া হোক। সংশ্লিষ্ট মার্কিন কর্মকর্তা ও ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা চার পশ্চিমা কূটনীতিক সূত্রে এমন কথা জানা গেছে।
এ ব্যাপারে উইটকফের কার্যালয়, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, পররাষ্ট্র দপ্তর, ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ওয়াশিংটনে রাশিয়ার দূতাবাসের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল রয়টার্স। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।

সাধারণ নিরাপত্তাবিধি ভেঙে রাশিয়ার বিশেষ দূত কিরিল দিমিত্রিয়েভকে নিজের ব্যক্তিগত বাসভবনে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন উইটকফ। এরপর হোয়াইট হাউসে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।
তবে সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তি বলেছেন, হোয়াইট হাউস ও পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এ ব্যাপারে উইটকফকে সতর্ক করা হয়। সাধারণত মার্কিন কর্মকর্তারা রাশিয়া থেকে আসা কর্মকর্তাদের নিজেদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি এড়িয়ে চলেন।
শেষ পর্যন্ত উইটকফের বাড়িতে আর নৈশভোজ হয়নি, বরং হোয়াইট হাউসেই এর আয়োজন করা হয়।
উইটকফ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনেক দিনের বন্ধু। গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয় অর্জনে তিনি ট্রাম্পকে সহযোগিতা করেছেন। ইউক্রেনকে নিয়ে সংশয়বাদী কিছু রিপাবলিকান সদস্য উইটকফকে সমর্থন দিলেও তাঁর প্রস্তাবের বিষয়ে অন্য রিপাবলিকানরা ক্ষোভ জানিয়েছেন। এসব রিপাবলিকান সদস্যের ধারণা, ট্রাম্প প্রশাসন ব্যাপকভাবে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
কার্লসনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উইটকফ রাশিয়াপন্থী যে অবস্থান দেখিয়েছেন, তাতে মার্কিন কংগ্রেসের কিছু রিপাবলিকান সদস্য এতটাই উদ্বিগ্ন হয়েছেন যে তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর প্রতি আহ্বান জানান।
গত জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এনেছেন। যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে তিনি ইউক্রেনকে চাপ দিচ্ছেন। পাশাপাশি ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার পর বাইডেন প্রশাসন ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে যেসব শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার অনেকগুলোই ট্রাম্প শিথিল করে দিয়েছেন।
উইটকফ ট্রাম্পের কৌশল অনুসরণ করায় মার্কিন ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের কেউ কেউ উদ্বেগে পড়েছেন। তাঁদের আশঙ্কা, আলোচনার টেবিলে বসার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তাঁর না থাকায় রুশ পক্ষ এর ফায়দা নিতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জানাশোনা থাকা দুই কর্মকর্তা এবং আরও কয়েকজন ব্যক্তির সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
গত ২৬ মার্চ রিপাবলিকান দলের গুরুত্বপূর্ণ অনুদানকারী এরিক লেভিনের লেখা এক চিঠিতে বলা হয়, ‘উইটকফকে সরতে হবে, তাঁর জায়গায় রুবিওকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
রিপাবলিকান দলের অনুদানকারীরাসহ কয়েকজনের কাছে চিঠিটি পাঠানো হয়। চিঠিটি লেখা হয়েছে কার্লসনকে সাক্ষাৎকার দেওয়া এবং ফক্স নিউজে উইটকফের উপস্থিতির পর। পুতিনের প্রশংসা করায় চিঠিতে উইটকফের সমালোচনাও করা হয়েছে।
ট্রাম্প বারবারই বলেছেন, তিনি চান, মে মাস নাগাদ ইউক্রেনে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হোক।
তবে আংশিকভাবে হওয়া দুটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্থবির হয়ে আছে। সেগুলোর একটি জ্বালানি অবকাঠামো এবং অপরটি কৃষ্ণসাগর নিয়ে হওয়ার কথা ছিল। এ ক্ষেত্রে তেমন একটা অগ্রগতি না হওয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতাশা প্রকাশ করেছেন।

উইটকফের পক্ষে-বিপক্ষে মত
ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিতে উইটকফ একটি কেন্দ্রীয় ও ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালন করেন। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের আগেও উইটকফ গাজায় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করেছিলেন। যদিও গাজার সে যুদ্ধবিরতি তখন থেকে অমীমাংসিত অবস্থায় আছে। এরপর রাশিয়া থেকে মার্ক ফোগেল নামের এক মার্কিন নাগরিককে দেশে ফেরানোর জন্য আলোচনা করেছিলেন তিনি।
গতকাল শুক্রবার পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে উইটকফ রাশিয়ায় যান এবং ইরানের সঙ্গে আলোচনার জন্য আজ শনিবার তাঁর মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার কথা। এটি কার্যত উইটকফের জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত আরেকটি শীর্ষ অগ্রাধিকারের বিষয়।
গত ২১ মার্চ কার্লসনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উইটকফ চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চলকে রাশিয়ার কাছে হস্তান্তরের ধারণা প্রকাশ্যে উত্থাপন করেছিলেন। এ চারটি অঞ্চল হলো লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল সম্পর্কে উইটকফ বলেন, ‘তারা রুশভাষী। সেখানে অনুষ্ঠিত গণভোটে বিপুলসংখ্যক মানুষ ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তাঁরা রাশিয়ার শাসনাধীন থাকতে চান।’
উইটকফের মন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের অনেক জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে হতবাক করেছে। তাঁদের মতে, বিশেষ দূতের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রুশ কর্মকর্তাদের চাওয়ারই প্রতিফলন ঘটেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে তাড়াহুড়ো করে আয়োজিত ওই গণভোটকে একটি প্রহসন বলে অভিহিত করেছে। তারা এ গণভোটের ফলকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
কার্লসনকে উইটকফ সাক্ষাৎকার দেওয়ার মাত্র কয়েক দিন পরে রুপার্ট মারডুকের নিউজ করপোরেশনের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ‘স্টিভ উইটকফ টেকস দ্য ক্রেমলিনস সাইড’ বা ‘স্টিভ উইটকফ ক্রেমলিনের পক্ষ নিচ্ছেন’ শিরোনামে একটি উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
ডেমোক্র্যাটরাও উইটকফের সমালোচনা করেছেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসন মেয়াদে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্বপালনকারী নেড প্রাইস বলেন, ‘উইটকফ ও ট্রাম্প এক বিশাল কূটনৈতিক পাপ করেছেন। একটি চুক্তির জন্য তাঁদের মরিয়া মনোভাব পুরোপুরি প্রকাশ করেছেন তাঁরা।’
তবে প্রশাসনের ভেতর উইটকফের অনেক সমর্থকও আছেন। তাঁরা বলেন, পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কিছু কর্মকর্তা তাঁর বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে কুৎসা রটাচ্ছেন।
কয়েকটি সূত্র বলেছে, উইটকফ ও ট্রাম্পের মধ্যে এখনো শক্তিশালী ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস সংবাদমাধ্যম দ্য হিলকে পাঠানো এক বিবৃতিতে উইটকফের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।
মার্কিন মিত্ররা কী ভাবছে
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলো মনে করে, শান্তিচুক্তির জন্য অগ্রগতি না হওয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট পরিকল্পনার অভাব আছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্প্রতি যোগাযোগ হয়েছে, এমন দুই ইউরোপীয় কর্মকর্তা বলেছেন, দ্রুত ফল পাওয়ার জন্য আলোচনাকারী দলকে চাপ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে তাঁরা উদ্বেগ জানিয়েছেন, বলেছেন, কেবল ইউক্রেনকেই নয়, বরং ইউরোপের নিজস্ব নিরাপত্তাকাঠামোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এমন পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিতে পারে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তারা বলেছেন যে তাঁরা তাঁদের আলোচনা থেকে আশ্বস্ত হতে পারেননি। মার্কিন পক্ষের সুস্পষ্ট চূড়ান্ত লক্ষ্য আছে বলে তাঁদের মনে হয়নি।