চলতি বছর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ৭৪টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ এবং তা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। পত্রিকার প্রতিবেদন এবং নিজস্ব মানবাধিকার কর্মীদের তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় এ প্রতিবেদন। আসকের হিসাবে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবার দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যায় সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। মোট ৭৪টি সংঘাতের ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন।
সংঘাতে আহত হয়েছেন ১ হাজার ৪৬১ জন। এ সময় আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ও বিএনপির সংগঠন ছাত্রদলের মধ্যেও সংঘর্ষ হয়। দুই ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ১০টি সংঘর্ষে আহত হন ৭৪ জন।
চলতি বছর বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের যত সংঘাত ও সেসব ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়েছে, তা–ও গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ সময় ১ হাজার ৩৯টি সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারান পাঁচজন। চলতি বছর ছাড়া বাকি চার বছরে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো। এর তীব্র বিরোধিতায় নামে তারা। ২০১৩ সালের শেষের দিক থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগপর্যন্ত রাজনৈতিক হানাহানি ঘটে ব্যাপক হারে। দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়। ২০১৫ সালেও এ অবস্থা চলে। তবে এরপর পরস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। ২০১৮ সালে নির্বাচনের বছরে আবার দুই দলের মধ্যে সংঘাত কিছুটা বাড়ে।
আগের নির্বাচন বয়কট করলেও ২০১৮ সালে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এরপর দলটি তেমন কোনো জোরালো কর্মসূচি দেয়নি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে তারা ঢাকাসহ আট বিভাগে বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি নেয়। বিএনপির এসব সমাবেশ ঘিরে রাজনৈতিক উত্তেজনো বাড়ে। বিভিন্ন স্থানে পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া ও নেতা-কর্মীদের বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে এসব সমাবেশ হয় ঘোষণা মেনেই। শেষে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ হয় গোলাপবাগ মাঠে।
সরকারের এ মেয়াদে মাঠে প্রায় নিষ্ক্রিয় বিএনপির এ বছরের শেষ দিকে সক্রিয় হয়ে ওঠা এবং তাতে বাধা দেওয়ার কারণেই দুই দলের মধ্যে সংঘাত বেড়েছে বলে মনে করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান। তিনি বলেন, বিরোধী দলের ওপর বল প্রয়োগের সংস্কৃতি এখনো বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে। সরকার আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়েছে। সমঝোতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এটা বেড়েই চলবে। ২০২৪ সালে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা এসেছে। যদি রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা না তৈরি হয়, তবে আগামী বছরে এসব সংঘাত আরও বেড়ে যাবে
এ বছর সংঘাত বেড়ে যাওয়ার জন্য সরকারের অসহিষ্ণু আচরণকে দায়ী করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি গতকাল বলেন, ‘ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক সংঘাত বেড়ে যাওয়ার কারণ সেটাই। সব ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিএনপি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আক্রমণের শিকার। এসব ঘটনা কোনোক্রমেই প্রত্যাশিত নয়, তবে দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা ঘটছে। সরকার সংযত হলে এসব ঘটনা ঘটতেই পারত না।’
চলতি বছর সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ‘বিএনপির চিরাচরিত সহিংস আচরণ’কে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলন মানে পেট্রল বোমা, মানুষ হত্যা। এটা এ দেশের প্রতিটি নাগরিক ২০১৩ থেকে শুরু করে পরের বছরগুলোতে দেখেছেন। বিএনপি এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।’
তবে রাজনৈতিক সংঘাতের সংখ্যা এতটা বেড়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন হানিফ। তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক নানা ঘটনাকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হয়। বিএনপির কোনো ব্যক্তি এসব ঘটনায় জড়িয়ে পড়লে তখন রাজনৈতিক কারণকে তুলে ধরা হয়।’
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সম্প্রতি যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এ জন্য গতকাল গণমিছিলের ডাক দেয় বিএনপি। তাদের সমমনা দলগুলোও একই কর্মসূচি নেয়। বিএনপির মিছিল নিয়ে কোনো সংঘাত না হলেও জামায়াতে ইসলামীর মিছিল করার সময় পুলিশের সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ কয়েকজনকে আটক করে। জামায়াতের কর্মীদের হামলায় কয়েক সদস্য আহত হয় বলেও জানায় পুলিশ। আগামী ১১ জানুয়ারি আবার বিএনপি ও সমমনা দলগুলো অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে। আগামী বছরজুড়েই বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে যাবে দলগুলো। আগামী বছরে রাজনৈতিক উত্তাপ কী আরও বাড়বে, তা থেকে সংঘাতের ঘটনাও কী বেড়ে যাবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘কথার লড়াই চলুক, শক্তিশালী রাজনৈতিক কথার লড়াই হোক, এটা আমরা চাই। কিন্তু সংঘাত একেবারেই চাই না। আর সংঘাতহীন সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা তো রাজনৈতিক দলগুলোই নিশ্চিত করতে পারে।’
অধ্যাপক শান্তনু মনে করেন, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে জ্বালাও-পোড়াওয়ের যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তা আবার শুরু করে সেটা বহন করার মতো শক্তি কোনো দলেরই নেই। তাঁর কথা, ‘অধিকার ও দায়িত্বশীলতা যেমন সরকারের, তেমনি বিরোধী দলেরও আছে। প্রধান বিরোধী দল বা যে কেউ কোনো অগণতান্ত্রিক শক্তির ওপর ভর করবে না, এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমাদের আস্থা রাখতে হবে। তারা যদি তাদের অধিকার ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়, তবে সংঘাত পরিহার করা সম্ভব।’