বর্ষাকালের আগেই ভাঙন

কাজলা ইউনিয়নের চরঘাগুয়া, টেংরাকুড়া ও বেড়া পাঁচবাড়িয়ায় এক সপ্তাহে ১৫টি বসতবাড়ি বিলীন

0
103
যমুনা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ভাঙন তীব্রতর হয়েছে। বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। গত শুক্রবার বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চরঘাগুয়া এলাকায়

বগুড়ার সারিয়াকান্দির কাজলা ইউনিয়নের গ্রাম চরঘাগুয়া। যমুনা নদীর এই দুর্গম চরে চার বিঘা জমিতে ভুট্টা ও তিন বিঘায় পাটের আবাদ করেছিলেন কালু প্রামানিক (৬০)। মাসখানেকের মধ্যে খেতের ফসল ঘরে তোলার কথা ছিল। ফসল বিক্রি করে কোরবানির গরু কেনার আশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু যমুনার ভয়াবহ ভাঙনে তাঁর সাত বিঘা আবাদি জমি বিলীন হয়ে গেছে।

গত এক সপ্তাহে যমুনা নদীর ভাঙনে সাজাহান প্রামানিকের (৫২) বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। তিনি চরঘাগুয়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

কাজলা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের চরঘাগুয়া, টেংরাকুড়া ও বেড়া পাঁচবাড়িয়ায় এক সপ্তাহের ভাঙনে ১৫টি বসতবাড়ি ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। আতঙ্কে রয়েছেন সেখানকার ২০ হাজার বাসিন্দা। কাজলা ইউনিয়নের জামথল খেয়াঘাট থেকে টেংরাকুড়া, চরঘাগুয়া হয়ে চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের মানিকদাইড় পর্যন্ত যমুনা নদীর বাঁ তীরের প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রবল ভাঙন দেখা দিয়েছে। এখানে তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি করে উচ্চবিদ্যালয় ও মাদ্রাসা, একটি করে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক, ছয়টি মসজিদ রয়েছে। এ ছাড়া কটাপুর ও আনন্দবাজার নামে দুটি বড় বাজার রয়েছে। নদীভাঙনে এসব প্রতিষ্ঠান ও বাজার হুমকির মুখে।

চরঘাগুয়া গ্রামের বাসিন্দা ও কাজলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী মোল্লা বলেন, নদীভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) তীর রক্ষার কাজ করছে। তবে পাউবো যেখান থেকে কাজ শুরু করেছে ঠিক তার উজানে সাত কিলোমিটার অংশে তীর রক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে এই অংশে নদীভাঙন প্রবল আকার ধারণ করেছে। নদী লোকালয়ের দিকে ধেয়ে আসায় চরের লোকজন আতঙ্ক–উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। ভাঙন ঠেকাতে বর্ষার আগেই জরুরি ভিত্তিতে নদীতীরে পর্যাপ্ত জিও ব্যাগ ফেলা দরকার।

ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যমুনা পাড়ি দিয়ে চরঘাগুয়ায় যেতে হয়। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, যমুনায় প্রবল স্রোত। ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। মাটি ও বালুর স্তূপ ধসে পড়ছে নদীতে। বিলীন হচ্ছে তীরবর্তী ফসলি জমি ও লোকালয়। জামথল খেয়াঘাট থেকে টেংরাকুড়া ও চরঘাগুয়া হয়ে মানিকদাইড় পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার একাকাজুড়ে যমুনা নদীর বাঁ তীর এলাকায় ভাঙন প্রবল আকার ধারণ করেছে।

এক সপ্তাহের ভাঙনে বসতভিটা ও আবাদি জমি বিলীন হয়েছে নছের শেখের (৬০)। একসময় সংসারে সচ্ছলতা থাকলেও এখন তিনি নিঃস্ব। নদীতীরে বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যমুনা ফুঁসে উঠিচে। বসতভিটা, ফসলি জমি যমুনা সব গিলে খাচ্চে। কূলকিনারা না পায়্যা অ্যানা দূরত আসে বেড়ার ঘর তুলে আশ্রয় লিচি। সেটিও ধেয়ে আসিচ্চে নদী। এখন কোন্টে মাথা গোঁজার ঠাই পামো সেই ঠিকানা খুঁজে পাচ্চি না।’

জেলে সাহিদার মোল্লা, মাঝি রেজাউল করিম ও গৃহবধূ মোমেনা বেগম জানালেন, বর্ষাকালের আগেই ভাঙনে দিশাহারা চরঘাগুয়ার বাসিন্দারা। গত এক মাসে প্রায় আধা কিলোমিটার অংশ ভেঙে যমুনা লোকালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

নদীতীরে বসে কূল ভাঙার দৃশ্য একদৃষ্টিতে দেখছিলেন কৃষক সাহার আলী প্রামানিক (৭৫)। চোখেমুখে উদ্বেগ–আতঙ্ক। তিনি বলেন, ‘জমিনত ভুট্টা আচলো, পাট আচলো। যমুনার প্যাটত বেমাক শ্যাষ।’

ওই গ্রামের বাসিন্দা ও কাজলা ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনিস মোল্লা বলেন, ‘হঠাৎ করেই লদী যে এতডা কাছাকাছি চলে আসপি কেউ ভাবেইনি। দেকতে দেকতেই কয়ডা বসতবাড়ি লদীর মদ্দ্যে চলে গেল।’

যমুনার বাঁ তীর সংরক্ষণ ও ভাঙন রোধে কাজ করছে জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড। জানতে চাইলে পাউবোর জামালপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, সারিয়াকান্দি উপজেলার জামথল ঘাটসংলগ্ন এলাকা থেকে ভাটির দিকে ৬ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার অংশে যমুনা নদীর বাঁ তীর সংরক্ষণে ৫৭৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। এই প্রকল্পের কাজ যেখান থেকে শুরু হয়েছে, সেখান থেকে উজানে চরঘাগুয়ার দিকে অবশিষ্ট অংশে তীর সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চলছে। বর্ষা মৌসুমে জিও টেক্সট ব্যাগ ফেলে জরুরি তীর প্রতিরক্ষামূলক কাজের জন্য প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.