আলু পেঁয়াজের সরকারি দর কার্যকর হয়নি দুই সপ্তাহেও

0
157
আলু ও পেঁয়াজ

দুই সপ্তাহ আগে সরকার আলু, দেশি পেঁয়াজ ও ডিম—এই তিন পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল। এখনো বাজারে পেঁয়াজ ও আলুর দাম কার্যকর হয়নি। ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল বাজারের তখনকার দরের সামান্য কম। এখন কোনো কোনো বাজারে সেই দরে পাওয়া যাচ্ছে। তবে ছোট বাজার ও পাড়ার মুদিদোকানে বাড়তি দামেই ডিম বিক্রি হচ্ছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। তবে তাতে কাজ হচ্ছে না। বরং সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হওয়ার অভিযোগ উঠছে।

আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের বাইরে চিনি, সয়াবিন তেল ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) নির্ধারিত দর রয়েছে। এর মধ্যে শুধু সয়াবিন তেল নির্ধারিত দামে পাওয়া যাচ্ছে, চিনি ও এলপিজি নয়।

ডিম
ডিম, ফাইল ছবি

রাজধানীর পলাশী, নিউমার্কেট, হাতিরপুল ও কাঁঠালবাগান বাজার ঘুরে গতকাল বুধবার দেখা যায়, আলু কিনতে ক্রেতাদের দিতে হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। যদিও নির্ধারিত দর ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা। দেশি পেঁয়াজের নির্ধারিত দর ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা। যদিও বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজি। ডিমের দাম কোথাও কোথাও প্রতি হালি ৪৮ টাকা, কোথাও কোথাও ৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়। সরকার নির্ধারিত দর ৪৮ টাকা।

বাজারগুলোতে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। যদিও নির্ধারিত দর ১৩০ টাকা। ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম রাখা হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ থেকে দেড় হাজার টাকা। যদিও সরকার নির্ধারিত দর ১ হাজার ২৮৪ টাকা।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, অভিযানের ফলে বাজারে নতুন করে দাম বাড়েনি। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। তিনি বলেন, ঢাকায় ডিমের দাম কমেছে। আলুর ক্ষেত্রেও কিছুটা পরিবর্তন আছে। দেশি পেঁয়াজের দাম সেই তুলনায় কম কমেছে। বাজারে অভিযান চলমান থাকবে।

দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার (আগস্ট মাসে) খবর আসার পর ১৪ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে আলু, ডিম ও দেশি পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ওই দিন আগের ধারাবাহিকতায় সয়াবিন তেলের নতুন দাম জানানো হয়, যা আগের নির্ধারিত দরের চেয়ে লিটারপ্রতি ৫ টাকা কম। চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল আগস্ট মাসে। আর প্রতি মাসে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এলপিজির দাম ঠিক করে দেয়।

বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কার্যকর হতে দেখা গেছে। কিন্তু চিনি নির্ধারিত দরে কখনোই বিক্রি হয়নি। এলপিজিও না। এবার দেখা যাচ্ছে, দাম কার্যকর না হওয়ার তালিকায় পেঁয়াজ, ডিম ও আলুও ঢুকছে।

ঢাকার বাইরে গতকাল রংপুর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, নোয়াখালী, ফরিদপুর, সিলেট, ঠাকুরগাঁও, খুলনা ও রাজশাহী জেলা শহরে বাজারদর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। দেখা গেছে, কোথাও আলু, পেঁয়াজ ও চিনির দাম কার্যকর হয়নি। ডিম কোথাও কোথাও হালি ৪৮ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

ঢাকার পলাশী বাজারের সাবিহা স্টোরের বিক্রেতা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আলু ও পেঁয়াজের দামে বড় কোনো পরিবর্তন নেই। আগের মতোই আছে। আমরা পাইকারি বাজার থেকে কমে কিনতে পারছি না। এ জন্য খুচরায়ও দাম কমছে না।’

ঢাকার বাইরে গতকাল রংপুর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, নোয়াখালী, ফরিদপুর, সিলেট, ঠাকুরগাঁও, খুলনা ও রাজশাহী জেলা শহরে বাজারদর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। দেখা গেছে, কোথাও আলু, পেঁয়াজ ও চিনির দাম কার্যকর হয়নি। ডিম কোথাও কোথাও হালি ৪৮ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য ডিমের দাম এত বেশি নির্ধারণ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

কুষ্টিয়ার জ্যেষ্ঠ কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান বলেন, বাজারে অভিযানের সময় দাম কমে। পরে আবার বেড়ে যায়। রোববার থেকে আবার অভিযান চলবে।

নিত্যপণ্য

১০৬৮টি অভিযান

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ১৫ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাজারে নির্ধারিত দর কার্যকর করার অভিযান চালানো হয়েছে ১ হাজার ৬৮টি। এসব অভিযানে ব্যবসায়ীদের ৪৪ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সর্বশেষ দুই দিনের অভিযানের হিসাব অধিদপ্তর দেয়নি।

এমন অভিযান কতটুকু কার্যকর হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেমন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান, তখন বাজারে অভিযান চালিয়েও খুব বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব না। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে যেসব উপায়-উপকরণ আছে, তার সঠিক ব্যবহার করতে হবে। তাহলে বাজার একটা সময় নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।

গোলাম রহমান আরও বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সুযোগ না থাকলেও বিশেষ অবস্থায় যদি দাম নির্ধারণ করতেই হয়, তবে সে ক্ষেত্রে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। তাহলে সুফল পাওয়া সম্ভব।

দাম কমাতে ১৮ সেপ্টেম্বর চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। তিন দিন পরে দেওয়া হয় আরও ছয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি। যদিও এখনো আমদানি করা কোনো ডিম দেশে আসেনি।

ডিম আমদানির অনুমতি পাওয়া টাইগার ট্রেডিংয়ের মালিক সাইফুর রহমান বলেন, তাঁরা আমদানির অনুমতিপত্র (ইমপোর্ট পারমিট বা আইপি) পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।

‘আমাদের মতো মানুষ খাবে কী’

দেশে গত বছর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। সরকারও জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়িয়েছে। এতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ওদিকে মার্কিন ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি যে কমবে, সেই লক্ষণও নেই। কারণ, ডলারের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমেছিল। ডলারের বাড়তি দামের কারণে এর সুফল পাওয়া যায়নি।

শুধু ডিম, আলু বা পেঁয়াজ নয়, বেড়েছে প্রায় সব পণ্যের দামই। যে চাষের পাঙাশের কেজি ১২০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে থাকত, তা এখন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।

রাজধানীর কাঁঠালবাগান বাজারে গতকাল দুপুরে বাজার করছিলেন আকলিমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমাগো মতো মানুষ খাইব কী। মাছ-মাংসের কথা বাদ দেন, সবজিরও তো দাম কমে না।’

রাজশাহী নগরের সাহেববাজার এলাকার বাসিন্দা রাজশাহী কলেজশিক্ষার্থী বর্ণা আক্তার গিয়েছিলেন স্থানীয় বাজারে। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে গোল বেগুনের দাম ছিল কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এখন সেটা ৭০ টাকা। অন্যান্য পণ্যের দামও বেশি।

দাম বেঁধে দেওয়া ‘যৌক্তিক নয়’

বেঁধে দেওয়া দাম কেন কার্যকর হয় না, তা নিয়ে গতকাল একটি দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখেছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, কৃষির মৌলিক পণ্যের দাম নির্ধারণ কৌশলটি যৌক্তিক নয়। কারণ, এসব পণ্যের বাজারে বিক্রেতার সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। তাঁর মতে, মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আগে বৃদ্ধির কারণটি বুঝতে হবে। কৃষিপণ্যের দাম বাড়ে সরবরাহে ঘাটতির কারণে।

শামসুল আলম আরও বলেন, কারসাজির সুযোগ তখনই তৈরি হয়, যখন সরবরাহে ঘাটতি থাকে। ঘাটতি হলে আমদানি করতে হবে। মূল্য অধিক বৃদ্ধি পেলে আমদানি উত্তম দাওয়াই, তখন ‘সিন্ডিকেট’ হওয়ার সুযোগ থাকে না। দাম বেঁধে দেওয়া মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়।

ফয়জুল্লাহ

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.