বৈশাখের এক রাতে সিলেট শহর থেকে রওনা দিলাম শিল্পী হায়দার রুবেলের মোটরবাইকে চড়ে। ঝোড়ো বাতাস বইছে। নিকষ কালো অন্ধকারকে আগাগোড়া ধারালো ছুরির মতো তীক্ষ্ণ বিজলি ঘন ঘন চিরে দিচ্ছে । বৃষ্টি ঝরছে অকাতরে। বৃষ্টির ধারালো সুচের খোঁচা থেকে বাঁচতে টুকেরবাজারে থামলাম। ডিম-খিচুড়ির ব্যস্ত এক দোকান। দুজনে দুই থালা সাবাড় করতে করতে বৈরী আবহাওয়া সামান্য সদয় হলো।
আবহাওয়া থম মেরে আছে। উদরও শান্ত। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছানো গেল সুনামগঞ্জের ছাতকের আলমপুর গ্রামে। এখানে বসবাস কারি আমীর উদ্দিন আহমদের। মালজোড়া আর বাউলগানে তাঁর বিরাট সুখ্যাতি। তাঁর সুরেলা কণ্ঠে একসময় শিহরণ জেগেছে সিলেটসহ পুরো হাওরাঞ্চলে। পাল্লা দিয়ে গান গেয়েছেন শাহ আবদুল করিম আর দুর্বিন শাহদের সঙ্গে। মালজোড়া গানের তর্কের আসরে হারিয়েছেন দেশের বাঘা বাঘা শিল্পীকে। সান্নিধ্য পেয়েছেন নেত্রকোনার বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন, উকিল মুনশি, জালাল উদ্দীন খাঁর মতো শিল্পীদের।
এমন শিল্পীর কপালেও শান্তি সয়নি। ২০০৪ সালে তাঁকে দেশছাড়া হতে হয় ধর্মীয় উগ্রবাদীদের চাপে। যুক্তরাজ্যে মেনে নিতে বাধ্য হন নির্বাসিতের জীবন। প্রবাসজীবনে থিতু হওয়ার পর শিল্পী এবার চতুর্থবারের মতো এসেছেন নিজের মাটিতে। গিয়েছিলাম তাঁরই সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপনের জন্য।
আমীর উদ্দিন আহমদ শুধু গাইয়ে নন, হাজারো গানের রচয়িতাও। তাঁর লেখা ‘লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে’, ‘কী সুখে যায় দিন-রজনী, কেউ জানে না’, ‘হেলায় হেলায় কার্য নষ্ট’, ‘কে এমন চাঁদ রূপসী’ গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এর বাইরেও তাঁর লোকপ্রিয় গান অনেক। বরেণ্য শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা গেয়েছেন তাঁর লেখা ‘তোমারে দেখিবার মনে চায়’ গানটি। গেয়েছেন মমতাজসহ অনেক লোকসংগীতশিল্পী। আশির দশকে জনপ্রিয় ছিল গানের ক্যাসেট। হাওরাঞ্চলে সে সময় অন্য শিল্পীদের ক্যাসেট যখন বিক্রি হতো কয়েক শ কপি; আমীর উদ্দিনের বিক্রি হতো কয়েক হাজার। প্রবাস সেই তুমুল জনপ্রিয় শিল্পীকে অনেকের কাছে অচেনা করে তুলেছে।
বৈশাখের ওই গাঢ় অন্ধকার রাত আমীর উদ্দিন আহমদের স্পর্শে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রাতভর বিস্তর আলাপ হলো তাঁর সঙ্গে। তাঁর স্মৃতিভারাতুর কথায় জেগে উঠল সত্তর আর আশির দশকে মালজোড়া গানে সিলেট, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহের হাওরাঞ্চলের মুখর জনপদের ছবি। সে সময় কোথাও তাঁর গানের আসর বসলে আগেভাগেই আয়োজকেরা সে খবর লেটারপ্রেসে একরঙা পোস্টার ছেপে হাটবাজারে সাঁটিয়ে দিতেন। মানুষ মুখিয়ে থাকত আসরের জন্য।
কারি আমীর উদ্দিন আহমদের ছেলে আরিফ উদ্দিন আহমদও যোগ দিলেন গল্পে। হারানো অতীতের গল্প ফিরে এল। গ্রামীণ জীবনে কোনো সচ্ছল গৃহস্থ বা গ্রামবাসীর উদ্যোগে তখন বাউলগানের আসর বসানোর রীতি ছিল। শিল্পীদের সম্মানীর খরচ আয়োজকেরাই জোগাড় করতেন। আমীর উদ্দিনের ক্ষেত্রে এ নিয়ম খাটত না। সে সময়েই তাঁকে ৫০ হাজার থেকে প্রায় ১ লাখ টাকা সম্মানী দিতে হতো। আয়োজকেরা তাই প্যান্ডেল বেঁধে দর্শনীর বিনিময়ে তাঁর গানের আসর করতেন। দর্শক–শ্রোতার ভিড় উপচে পড়ত। খরচ শেষেও আয়োজকদের হাতে লাভের কড়ি থাকত যথেষ্ট। আসরের পর আসর তাই লেগেই থাকত। হাওরাঞ্চলে গানের আসরকে যেন সিনেমা হল বানিয়ে ফেলেছিলেন আমীর উদ্দিন।
কারি আমীর উদ্দিন আহমদ শিল্পী শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, কামাল উদ্দিন ও আবদুস সাত্তারদের সঙ্গে মালজোড়া গানের আসরে তাঁর দ্বৈরথের আনন্দভরা স্মৃতিচারণাও করলেন। তিনি জানান, ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের রচয়িতা গিয়াসউদ্দিন আহমদই সত্তরের দশকের শুরুতে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ‘সুজন বন্ধু’ গান গেয়ে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পাওয়া শিল্পী মো. শফিকুন্নূরকে।
৭৮ বছর বয়সী কারি আমীর উদ্দিন আহমদকে যেন কথায় পেয়ে বসেছে। উত্তর প্রজন্মের কারও কাছে এই অমূল্য স্মৃতি গচ্ছিত করে দিয়ে যাওয়া যেন এই শিল্পীর এক দায়ভার। আমরা অবাক হয়ে দেখতে থাকি, একজন শিল্পীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কী অপরূপভাবে কথা বলে চলেছে।