আমি যখন চলে গেলাম, পরপরই কাটপিস, অশ্লীলতা চেপে বসল আমাদের সিনেমায়: রোজিনা

0
177
রোজিনা

প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন চিত্রনায়িকা রোজিনা। তাঁর ছবি ‘ফিরে দেখা’ গত শুক্রবার দেশের ২২টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। পরিচালনার পাশাপাশি প্রায় দেড় যুগ পর এই ছবির মধ্য দিয়ে অভিনয়ে ফিরেছেন তিনি। সিনেমা নির্মাণ, অভিনয়ে ফেরাসহ নানা বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলল বিনোদন।

মুক্তির আগে সিনেমা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রচারে গিয়েছেন, মুক্তির পর হলেও যেতে দেখা গেল আপনাকে। অভিজ্ঞতা কেমন?

এ ধরনের অভিজ্ঞতা আগে ছিল না। আমরা যখন ছবি করতাম, প্রচারে দ্বারে দ্বারে যাওয়া লাগত না। রেডিও, টেলিভিশনে টানা বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নায়ক-নায়িকার ছবি দিয়ে বড় বড় বিজ্ঞাপন যেত। মানুষ বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে সিনেমা হলে আসতেন। এখন নতুন নতুন প্রচারের কৌশল, মাধ্যম বের হয়েছে। তবে মন্দ লাগছে না। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তরুণদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা শেয়ার করার সুযোগ পাচ্ছি। আমাদের সময়কার কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছি। এখন ঢাকার মধ্যে হলে হলে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

এই যে হলে যাচ্ছেন, কেমন প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন?

অনেক বছর অভিনয় না করলেও মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলেই হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছি। এবার নিজের সিনেমা দর্শকের সঙ্গে বসে দেখলাম। সিনেমা শেষে অনেকে আমার সঙ্গে ছবি তুলতে এলেন, ছবির প্রশংসা করলেন। সত্যিই এ এক অন্য রকমের অনুভূতি।

রোজিনা
রোজিনা

প্রথম সিনেমা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বেছে নিলেন কেন?

আমরা কিন্তু সহজে এ দেশকে পাইনি। এখানকার নতুন প্রজন্মের এ ধরনের সিনেমা দেখা উচিত। কীভাবে যুদ্ধ হয়েছিল, কেন হয়েছি, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে দেশীয় রাজাকাররা এ দেশের মানুষের ওপর কীভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, এসব দেখা উচিত, তাদের জানা উচিত। শেষ পর্যন্ত ছবি হিট বা আলোচনা হবে কি না, সেটা আমার কাছে বড় বিষয় নয়। চেতনার জায়গা থেকে, দেশের প্রতি আবেগ থেকে কাজটি করেছি। তবে ছবিটির শুটিং করতে গিয়ে একাত্তর সালের লোকেশন, পরিবেশ-পরিস্থিতি, এ সময়ে এসে ছবিতে তুলে আনা সহজ ছিল না।

রোজিনা
রোজিনা

সেই অভিজ্ঞতার কথা বলবেন?

ছবিটির গল্প অনেকাংশই আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। আমি ওই সময় গোয়ালন্দে নানাবাড়িতে থাকতাম। সেই সময় পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে ওই অঞ্চলের রাজাকাররা কী করছে, ওখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা, কিছু কিছু আজও মনে আছে আমার। সেসব গল্পে এনেছি। প্রায় দুই বছর আগে থেকে চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করেছি। ওই সব জায়গা আগের মতো অজপাড়া নেই। তাই একাত্তর সালের সেই নদী, সেই গ্রাম, সেই মেঠো পথ তুলে আনা অনেক কষ্ট হয়েছে। গোয়ালন্দের একদম ভেতরে কুমড়াকান্দি গ্রামে শুটিং করেছি। চারপাশের পরিবেশ মিলে যুদ্ধের সময়কার আবহটা আনতে অনেক সতর্ক হয়ে ক্যামেরা ধরতে হয়েছে।

পরিচালনায় নিয়মিত হবেন?

আপ্রাণ চেষ্টা করব। দীর্ঘদিন বড় বড় পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। আগে কিছু নাটক ও টেলিছবি পরিচালনা করেছি। অভিনয়ের চেয়ে পরিচালনা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য লেগেছে।

রোজিনা
রোজিনা

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গ, অভিনয় করতে করতে ১৯৯৬ সালে সব ছেড়ে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন কেন?

কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তখন শুটিংয়ে আটটায় কল থাকত। আটটা মানে আটটায়। তখন আমরা কাজপাগল ছিলাম। পয়সা কে দিল কে দিল না, খেয়াল থাকত না। সিনেমায় যে ভালো পারিশ্রমিক পাওয়া যায়, জানাই ছিল না। শুটিং আর শুটিং। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজই করেছি। সকালে এফডিসি, বিকেলে বিমানে করে কক্সবাজার। আবার পরের দিন ফিরেই মানিকগঞ্জ। এভাবেই শুটিং করতে হয়েছে। একসময় হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। টানা প্রায় ২৫০টি ছবিতে কাজ করেছি। ১৯৯৬ সালে দেশের বাইরে চলে গেলাম। এর পর থেকে যাওয়া-আসার মধ্যে ছিলাম। অবশ্য ২০০৬ সালে ফেরদৌসের বিপরীতে ‘রাক্ষুসী’ ছবিতে অভিনয় করেছি। এরপর প্রায় ১৭ বছর পর আবার নিজের পরিচালিত ছবিতে অভিনয় করলাম।

হাজার হাজার ভক্ত, সিনেমার রঙিন জীবন ছেড়ে যেতে খারাপ লাগেনি?

আমি যখন চলে গেলাম, পরপরই কাটপিস, অশ্লীলতা চেপে বসল আমাদের সিনেমায়। দুঃখ লাগত,আমি তো এমন সিনেমা রেখে আসিনি। এসব দেখে আর সিনেমা করার ইচ্ছা হয়নি। কাজ না করার জন্য খারাপও লাগেনি। দেশে এসে সিনেমা করার জন্য কারোর সঙ্গে যোগাযোগও করিনি। তবে ওই সময় আমি কলকাতায় কিছু রিমেক সিনেমা, বিশেষ করে ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘কুঁচবরণ কন্যা’, ‘রূপবান’ করেছি।

রোজিনা
রোজিনা

একসময় ‘জীবনধারা’, ‘দোলনা’, ‘রাধাকৃষ্ণ’সহ বেশ কিছু ছবি প্রযোজনা করেছেন। অভিনয়ের মতো প্রযোজনাও বন্ধ করে দিলেন কেন?

যে কটি ছবি করেছি, দর্শক পছন্দ করেছেন। ১৯৮৮ সালে নিজের প্রযোজিত ছবি ‘জীবনধারা’য় অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছি। নানা কারণে চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, চলচ্চিত্রতেই নেই, তো সিনেমা প্রযোজনা করে কী করব।

রোজিনা
রোজিনা

ববিতা, সুচরিতা, অঞ্জনা থেকে শুরু করে আপনার সমসাময়িক অনেকে এখন সিনেমায় অভিনয় করেন না।

বলিউড, হলিউডে বয়স সিনেমায় তেমন প্রভাব ফেলে না। কিন্তু আমাদের এখানে ভিন্ন চিত্র। হলিউডে তো ৪০-৫০ বছর বয়সের শিল্পীরাও মূল চরিত্রে অভিনয় করেন। বলিউডে অমিতাভ, রেখা, মাধুরীদের নিয়ে চিত্রনাট্য লেখা হয়। আমাদের এখানে প্রযোজক, পরিচালকেরা আমাদের মতো একসময়ে যাঁরা পর্দা কাঁপিয়েছেন, তাঁদের নিয়ে ভাবেনই না। আমি যখন সিনেমায় আসি, তখন সুজাতা, আনোয়ারা, সুচন্দা, আনোয়ার হোসেনদের মতো তারকারা ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আমরা যাঁরা আছি, তাঁদের কথা মাথায় রেখে যদি গল্প লেখা হতো, আমরাও অভিনয় করতে পারতাম। সিনেমা আরও সমৃদ্ধ হতে পারত। এখনকার সিনেমায় নায়ক-নায়িকা ছাড়া আর কিছু আছে? এখানে এখন যেভাবে সিনেমা হচ্ছে, নায়ক-নায়িকার বাইরে মা, খালা বা ভাবি চরিত্রগুলো অনেকাংশেই গুরুত্বহীন থাকে। আমাদের মতো শিল্পীদের জন্য গল্পে কাজের জায়গা রাখতে হবে।

দর্শকদের অনেকেই আপনার পরিবার সম্পর্ক জানতে চান।

১৯৯৩ সালে আমার স্বামী ফজলুর রহমান ঢালি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর আমি ১৯৯৬ সালে যুক্তরাজ্যে চলে গেলাম। ওই বছরেই মে মাসে ওখানে হোসেন মোহাম্মদ আনোয়ার শরীফের সঙ্গে বিয়ে হয় আমার। ওকে সবাই আনন বলে চিনত, জানত। দেখতে নায়ক নায়ক ভাব ছিল। ও দেশে এসে নায়কও হতে চেয়েছিল। ওর জন্য ছোটকু ভাই, ঝন্টু ভাই চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। বাদল খন্দকার, এহতেশম তাকে নায়ক বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লন্ডনে তার ব্যবসা থাকার কারণে সময় দিতে পারেনি। ফলে বেচারার আর নায়ক হওয়ার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। এখন সে লন্ডনেই থাকে। আমি মাঝেমধ্যে দেশে আসি। আমাদের কোনো সন্তান নেই। আমরা বেশ সুখে, আনন্দে জীবন যাপন করছি।

রোজিনা
রোজিনা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.