‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’: এক ভয়ংকর সুন্দর নান্দনিক অন্তর্ঘাত

0
190
‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নাটকের দৃশ্য

‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। তারুণ্যের ঢেউয়ে ঢেউয়ে দিন দিন উত্তাল হয়ে ওঠা ঢাকার নাট্যমঞ্চের এক বিপন্ন বিস্ময়ের নাম। এক ভয়ংকর সুন্দর নান্দনিক অন্তর্ঘাত। ‘ভয়ংকর সুন্দর’ উচ্চারণের পেছনে বিরোধাভাস আছে। এই বিরোধাভাসই এ নাটকের সোনার কাঠি। আর ‘অন্তর্ঘাত’ তার স্বভাবধর্ম। ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ এক প্রকাণ্ড প্রশ্নচিহ্ন হয়ে আমাদের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াচ্ছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইছে ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের বুকে নারী নির্যাতনের সেই ছবিকে, যা ভুলে যাওয়ার কুহেলিকায় ক্রমে আচ্ছন্ন, তা না হলে রাজনৈতিক দাবা খেলার বোড়ে।

স্পর্ধা ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভের দুই ঘণ্টা মেয়াদের এ প্রযোজনার পালা পড়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে। ১৬ জুন শুরু হয়ে লাগাতার ২১টি মঞ্চায়ন। চলবে মাসের শেষ অবধি।

সারস্বত অঙ্গনের দায়দায়িত্ব সামাল দিয়ে কয় বছর আগে পূর্ণোদ্যমে নাট্যাঙ্গনে ফিরে আসার দিনটি থেকেই সৈয়দ জামিল আহমেদের কাছে আমাদের প্রত্যাশার পারা চড়তে শুরু করেছে। গ্রুপ থিয়েটারের চালু ধাঁচের বাইরে এসে স্পর্ধা ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভ গড়ে উৎকর্ষের যে স্বতন্ত্র চর্চা তিনি শুরু করেছিলেন, ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ তাতে এক জরুরি ধাপ।

এর গড়নের সঙ্গে জামিল আহমেদের কয় বছর আগের কাজ ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র মিল আছে। দুটিই উপাত্ত সংগ্রহ করেছে গদ্যসাহিত্য থেকে। ফারাক বলতে ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র কাঠামো তৈরিতে শহীদুল জহিরের রচনাকে সমগ্রতায় ধরেছিলেন জামিল। ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ খণ্ডিত মাত্রায় ধরেছে ১৯৯৪ সালের একুশের বইমেলায় বেরোনো নীলিমা ইব্রাহিমের বইটিকে। মূল বইয়ে উত্তমপুরুষ একবচনে লেখা সাতটি আখ্যান ছিল। মুক্তিযুদ্ধের রণরক্ত-ক্লেদ মাখানো সাতটি আখ্যান। সাতটি আখ্যানের প্রতিভূ হিসেবে সাত অভিনেত্রীকে এ নাটকের পুরোভাগে রেখেছেন জামিল। গোড়ার দিকে তাঁদের দিয়ে অভিনয়ে চরিত্রের নামও বলিয়ে নিয়েছেন।

তবে পূর্ণাঙ্গতায় পাওয়া গেছে দুটি আখ্যান। একটির নায়িকা ময়না (শারমিন আক্তার শর্মী), যিনি ওই নারকীয় অভিজ্ঞতার পর নিজের জোরে পুনর্বাসনের পথ কেটেছিলেন, ডিঙিয়ে এসেছিলেন শতসহস্র প্রতিকূলতা। অন্যটির নায়িকা মেহেরজান (মহসিনা আক্তার)—অষ্টম শ্রেণির সেই ছাত্রী, যিনি শারীরিক সুখের কোনো অনুভূতি পাওয়ার আগেই ‘চোপ খানকি’ দাবড়ানি শুনে হতবাক হয়েছিলেন। তারপর যৌনলালসার উপকরণ হয়ে যুদ্ধের শেষে পাকেচক্রে পৌঁছে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের মাটিতে। অনেক দিন বাদে মাথা উঁচু করে ফিরে এসেছিলেন দেশের মাটিতে এবং বুঝেছিলেন, ‘আমি জীবনের সব পেয়েছি, কিন্তু মাটি হারিয়েছি।’ মেহেরজানের এ আখ্যানে ফিরে ফিরে এসেছেন স্বয়ং নীলিমা ইব্রাহিম (বুড়ি আলী)।

স্পর্ধা ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভের দুই ঘণ্টা মেয়াদের এ প্রযোজনার পালা পড়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে। ১৬ জুন শুরু হয়ে লাগাতার ২১টি মঞ্চায়ন। চলবে মাসের শেষ অবধি।

‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নাটকের দৃশ্য। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার স্পর্ধার নতুন প্রযোজনাটির প্রাক-উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়
‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ নাটকের দৃশ্য। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার স্পর্ধার নতুন প্রযোজনাটির প্রাক-উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়শুভ্র কান্তি দাশ

তবু মর্মন্তুদ এ আখ্যান নয়—আখ্যান তো বইয়ের পাতা ওল্টালেই পড়ে নেওয়া যায়—সৈয়দ জামিল আহমেদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় গড়ে ওঠা ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’র তুরুপের তাস হলো এর নির্মাণসৌকর্য। নাট্যভাষের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রাখা এক তুখোড় নাট্যনির্মাতার নিজস্বতার স্বাক্ষর। স্টুডিও থিয়েটার হলের প্রবেশপথে এলোমেলো ছড়িয়ে রাখা শাড়ি, সায়া, সেমিজ কিংবা কাচের চুড়ি পেরিয়েই মিলনায়তনে ঢুকেছিলাম। ভেবেছিলাম, থিয়েটার অব ক্রুয়েলটির একশেষ হবে বুঝি! হয়নি। দেখি, তিন দিক খোলা চৌকো পারফরম্যান্স স্পেস সাজানো।

নাটক শুরু হতেই বোঝা গেল, হরেক জায়গা থেকে হরেক রকমের আলো ফেলার বন্দোবস্ত করেছেন জামিল। ফ্লোর ম্যাট হয়ে উঠছে তাঁর ক্যানভাস। শুরুতে কোনো কথা নয়, পিয়ানোর নৈরাজ্যময় বাজনায় ভর করে সাইক্লোরামার ওপর কিছু ছবি ফেললেন জামিল। লাঞ্ছনার শিকার নারীর চিত্রমালা। একসময় তা থিতু হলো সিলেটের শালুটিকরে পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পের দেয়ালে আঁকা যৌনবিকারের সেই বীভৎস রেখাচিত্রে। ইতিমধ্যে একে একে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন সাত কুশীলব। সচল হয়েছে প্রেক্ষাপট। তারপর আমাদের সচকিত করে আরমীন মূসার সুরে ‘আমি একজন বীরাঙ্গনা’ গেয়ে উঠলেন সবাই। ঘাসফড়িং কয়্যারের গাইয়ে-বাজিয়ের দল সহযোগ দিল। লোকচক্ষে এই বীরাঙ্গনাকুল কীভাবে বারাঙ্গনা হলেন—এই খেদোক্তি নিয়েই মূল আখ্যানভাগে ঢুকে পড়লেন জামিল।

স্বগতোক্তির ধাঁচে সরলরৈখিক আখ্যান। স্পষ্ট উচ্চারণে প্রবল উদ্দীপনায় বলে চলেছেন কুশীলবকুল। কুশলী শারীরিক অভিনয়। পরিশ্রমী তো বটেই, পরিমার্জিতও। অথচ গ্রাফিক ভায়োলেন্সের ধার ধারছেন না জামিল। অনুশীলনের নিবিড় মাত্রায় নাচতে নাচতে একক স্বর কখনো বহুস্বরী হয়ে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা তৈরি করছে, তো কখনো সমস্বরে বাসা বাঁধছে। এ-গানে, এ-বাজনায় কোথাও বাংলার চেনাজানা সুরের আলপনা নেই। ‘আমার সোনার বাংলা’—তা–ও নেই। আমাদের আবেগের চোরা কুঠুরিতে হানাদারি নেই। কালেকটিভ আনকনশাসের ঢাকনি খুলে ডাকিনী-যোগিনী তুলে আনা নেই। প্রায় সবটাই পশ্চিমি গতে বাঁধা। তাই বলে বাখ-বেথোভেন নয়, একেবারে একেলে সাউন্ডস্কেপ। এমনকি অঙ্গভঙ্গিমাতেও নেই বাঙালি কালচারাল বডির লালিত্যময় অলংকার।

‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’র কুশীলবদের শরীর চলেছে জার্মান কি মার্কিন ঘরানার ব্যালের ছাঁদে। দৃঢ়তা ও ভঙ্গুরতার তালে তালে। শরীরকে তুলি আর আলোকে রং বানিয়ে একের পর এক ছবি আঁকছেন জামিল।

আর্তনাদে মিশে যাচ্ছে এডওয়ার্ড মুঙ্খ, ক্যাথে কোলভিজের ছবি। এমনকি পিয়েতার নানান ধরন। শিল্পের সংকরায়ণে আস্থাশীল জামিল। এই পারফরম্যান্স স্পেস যেন তাঁর নিরীক্ষাগার। এর প্রতিটি আনাচকানাচজুড়ে তাঁর কল্পবিশ্বের মানচিত্র। পেছনের দেয়ালের পাঁচটি আয়ত ও বর্গাকার কুলুঙ্গির খোদল জামিলের হাতযশে আলাদা এক দুনিয়ার আমেজ এনে দিল। অভিব্যক্তিবাদী যেসব ছবি ক্রমাগত এঁকে চললেন জামিল, সেগুলোর একাংশ ঠাঁই পেল ওই সব চোরা কুঠুরিতে। সেঁধিয়ে গেল আমাদের অবচেতনে।

এভাবে বিষয় তো বটেই, ‘কহে বীরাঙ্গনা বলছি’ আলাদা হয়ে রইল তার বহুবর্ণী বহুমাত্রিক বিন্যাসের জন্য। এর দরুন কাঙ্ক্ষিত অভিঘাতে কি খামতি হলো কোনো? হয়তো হলো। জামিলের জ্ঞাতসারেই হলো। বাঁধভাঙা আবেগের কাছে নতজানু হয়ে নয়, জামিল নিশ্চিতভাবেই চেয়েছেন তাঁর দর্শক যেন বোধবুদ্ধিতে শান দিতে দিতে মিলনায়তন থেকে নিষ্ক্রান্ত হন। ওই নারকীয়তার ভাগীদার হন। সহমর্মী হন। সংবেদনশীলতায় আতুর হন। অপরিচয়ের যে বাতাবরণ ঘিরে আছে ‘বীরাঙ্গনা’দের, তার ঘেরাটোপ থেকে রেহাই পান। তাঁদের বীর মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দিতে অকুণ্ঠ হন।

বলতেই হবে যে স্পর্ধার অভিনেত্রী সংঘের সবাই সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন। চরিত্র থেকে চরিত্রান্তরে গেছেন। জেন্ডার রিভার্সালের চাল দিয়ে বাজিমাত করেছেন অনায়াসে।

নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ।
নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ।

বলতেই হবে যে স্পর্ধার অভিনেত্রী সংঘের সবাই সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন। চরিত্র থেকে চরিত্রান্তরে গেছেন। জেন্ডার রিভার্সালের চাল দিয়ে বাজিমাত করেছেন অনায়াসে। তবু আলাদা করে বলতেই হয় মহসিনা আক্তারের কথা। মুহুর্মুহু ভোল বদলেছে তাঁর অভিনীত মেহেরজান চরিত্রের। ঢেঁকির দোলায় ওলট-পালট হয়েছে বাস্তবতা। অথচ মেহেরজানের মনস্তাত্ত্বিক নির্মাণে মহসিনার কোনো গাফিলতি নজরে আসেনি। এত ঋজুতা, এত মূর্ছনা তাঁর চরিত্রায়ণে।

‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’র ভূমিকায় নীলিমা লিখেছিলেন, ‘অনেকে সংবর্ধনা ও সম্মান জানানোর জন্য তাঁদের ঠিকানা চেয়েছেন। তার জন্য আরও এক যুগ অপেক্ষা করতে হবে।’

অংশুমান ভৌমিক
অংশুমান ভৌমিক

এর তিন দশক বাদে সংবাদমাধ্যমের জন্য ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’র বিশেষ মঞ্চায়নের শেষে জামিল বলেন, ‘পাকিস্তানিরা বীরাঙ্গনাদের ব্যবহার করেছে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে। আমরা বাংলাদেশিরা জাতীয়তাবাদের একটি প্রতীক হিসেবে পক্ষে বা বিপক্ষে লোক টানার জন্য বীরাঙ্গনাদের ব্যবহার করেছি। তাঁদের সম্মান দিতে শিখিনি।’

চরাচরব্যাপী এই শূন্যস্থান ভরাট করার জন্য ২১টি মঞ্চায়ন বড় কম পড়বে জানি। তবু ‘লালজমিন’, ‘বীরাঙ্গনার বয়ান’-এর পর এ প্রযোজনা দেশে বা বিদেশে গুমরে মরা অনেক আর্তনাদকে তার অসহ্য তীব্রতাসমেত গণপরিসরে ফিরিয়ে দিল। এক স্নায়বিক অথচ মানবিক পীড়নের মুখে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিল স্পর্ধার ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। বিনোদনের সাড়ে বত্রিশ ভাজায় বুঁদ হয়ে থাকা সমকালে এ পাওয়া নেহাত কম নয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.