অনুষ্ঠানস্থলের মঞ্চের ব্যানারে ছিল এই আন্দোলনের ডাক। জেএসএসের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন দলটির প্রধান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা। তাঁর কণ্ঠেও ছিল কষ্টের সুর।
সন্তু লারমা বলছিলেন, ‘চুক্তি ছিল আমার কাছে এক পবিত্র দলিল। পাহাড়ের মানুষের পক্ষে আমি চুক্তি করেছিলাম। এরপর আমি প্রতিদিন, প্রতি মাস, প্রতিটি বছর এর সফল বাস্তবায়ন দেখতে চেয়েছি। সরকারকে সহযোগিতা করতে চেয়েছি। আমরা পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পার হয়ে এসেছি। মনে হয়, সময়টা আমার জীবনের বৃথায় পার করে এলাম। যে সময়ে এ দেশের মানুষের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিকল্পে আরও কিছু অবদান রাখতে পারতাম, তা হলো না।’
আজ কথা বলার সময় সন্তু লারমা বারবার ফিরে গেছেন ২৫ বছরের আগের সময়ে। কারণ, দিনটি বিশেষ সময়, ২৫ বছর পূর্তি। আজ সেই সময় এসে তুলে ধরেছেন স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পাহাড়ের মানুষের লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত। মিলনায়তন ভরা দর্শক, গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তুলে ধরেছেন চুক্তির নানা দিক। যে আস্থা রেখে, বিশ্বাস করে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন, তা এখন তাঁর কাছে ‘ফলাফলহীন’। সন্তু লারমা বলেন, ‘আমার একটা দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু ফলাফলহীন ছিল এই ২৫ বছর। এটা ছিল অবর্ণনীয় যন্ত্রণার অনুভূতির বিষয়। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন তো হলোই না, বরং এ চুক্তি যেন মানুষ ভুলে যায়, তার ব্যবস্থাই করেছে সরকার ও শাসক গোষ্ঠী।’
১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। এরপর এ দফায় টানা প্রায় ১৪ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় দলটি। চুক্তি সম্পাদনকারী দলটির কাছে প্রত্যাশা তাই সংগত কারণেই বেশি, সন্তু লারমার বক্তব্যে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে আজ। কিন্তু তাঁর কথা, আশাহীনতা বেশি করে ঘটিয়েছে এ সরকারই। জেএসএস নেতা সন্তু লারমা বলেন, ‘সরকার আমাদের কথা বলতে দেয় নাই। আমাদের সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আমরা পাহাড়ের সমস্যা নিয়ে এবং সমতলের আদিবাসীদের নানা সমস্যা নিয়ে দেশে–বিদেশে নানা জায়গায় কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার সেটাতে বাধা প্রদান করে এসেছে। বাংলাদেশের উপনিবেশ হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাকিস্তান যেভাবে বাংলাদেশকে শোষণ করে এসেছে, তার চেয়ে অধিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন–শোষণ করে এসেছে এ দেশের শাসকগোষ্ঠী।’
চুক্তির ফলে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা। চুক্তি অনুযায়ী, পাহাড়ের সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার কথা ছিল এ পরিষদের। কিন্তু পাহাড়ে এখন নানা প্রশাসন চলে বলে অভিযোগ করেন সন্তু লারমা। তিনি বলেন, ‘পাহাড়ে যেন এক ভিন্ন ধরনের শাসনব্যবস্থা চলে। তাদের শাসনে পীড়িত পাহাড়ি প্রত্যেক নারী-পুরুষ। পাহাড়িদের সম্পদ লুণ্ঠনের যে চেষ্টা দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে, তা বন্ধ তো হয়নি, বরং দিন দিন তা বাড়ছে। তাদের উদ্বাস্তু করা হচ্ছে দিন দিন।’
সন্তু লারমা তাঁর নিজের কথা বলেন, ‘পানছড়িতে (খাগড়াছড়ি জেলার একটি উপজেলা) আমার গ্রামের বাড়ি। আমার গ্রামের বাড়িতে আমি যেতে পারি না। আমি নিজে উদ্বাস্তু।’
পাহাড়ে যেসব সশস্ত্র গ্রুপ আছে, তাদের কারা সৃষ্টি করেছে—আজকের বক্তব্যে সে প্রশ্ন করেন সন্তু লারমা। তিনি বলেন, ‘জনসংহতি সমিতিকে চিরতরে দমন করার জন্যই এসব গ্রুপগুলোকে সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই গ্রুপগুলোর মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে, অন্যের প্রাণ হরণ করা হচ্ছে। তার খবর এ দেশের শিক্ষিত মানুষ জানে না। এসব গ্রুপ চুক্তিবিরোধী।’ তাঁর পেছনে সরকার ‘গোয়েন্দা’ লাগিয়ে রাখে বলে অভিযোগ করেন সন্তু লারমা। তিনি বলেন, ‘আমি কোথাও গেলে এসব গোয়েন্দা কাছাকাছি অপেক্ষা করে। আমি কোথাও গেলে আমাকে ফলো করে। সরকার তো আমার নিরাপত্তার জন্য নির্দিষ্ট লোক দিয়েছে, তাহলে এভাবে ফেউ লাগিয়ে রাখা কেন। এর উদ্দেশ্য তো ভালো নয়।’
সন্তু লারমা আরও বলেন, ‘কেউ কেউ বলে সন্তু লারমা সব অস্ত্র জমা দেয়নি। ২৫ বছর আগে অস্ত্র জমা দিলাম, তা–ও এ কথা। কিন্তু ২৫ বছর ধরে অস্ত্র কী আর অস্ত্র থাকে, এগুলো তো লোহার টুকরা হয়ে যায়।’
বক্তব্যের প্রায় প্রতিটি অংশে চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে তাঁর হতাশা ও ক্ষোভের কথা বললেও চুক্তির সফল বাস্তবায়নেই যে পাহাড়ের সমস্যার সমাধান নিহিত, সে কথা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেন সন্তু লারমা। তিনি বলেন, ‘চুক্তির বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ের সমস্যার সমাধান কঠিনতর হয়ে উঠবে। এ চুক্তি পাহাড়ের মানুষ ভুলতে পারে না। এ চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে বৃহত্তর আন্দোলনের কথা ভাবা হচ্ছে। এ আন্দোলন কোন দিকে মোড় নেবে, তা আমি জানি না।’
এই বৃহত্তর আন্দোলন দেশের সব শিক্ষিত সমাজ ও গণমানুষকে শামিল হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
এই পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের লড়াই কেবল পাহাড়িদের নয়, এটা সম্মিলিত একটি লড়াই উল্লেখ করে আজকের সভার আলোচক রাশেদ খান মেনন বলেন, এ চুক্তি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনেসকোর শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। এটা বৃথা যেতে দেওয়া যায় না। সেদিন যখন শেখ হাসিনা চুক্তি করেছিলেন, তাঁর আগের অবস্থান এখন নেই। এখন বিশ্বনেতাদের কাতারে তাঁর অবস্থান। তাই চুক্তির বিষয়ে তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হস্তক্ষেপ দরকার।
আলোচনায় নারী নেত্রী খুশী কবির বলেন, ‘আমরা দেখছি, এই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে না গিয়ে দিনকে দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন নিজস্ব সত্তা নিয়ে দাঁড়াতে না পারে, তার জন্য কিছু মানুষের স্বার্থ আছে।’
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, ‘আমাদের মূল সমস্যা গণতন্ত্রহীনতা। চুক্তির এদিনে আমরা দেখি, জনসংহতি সমিতির এক ধরনের বক্তব্য এবং সরকারের বক্তব্য আরেক ধরনের।’
শুভেচ্ছা বক্তব্যে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, পত্রিকায় অনেক কথা বলা হয়েছে। ১০০টি ব্রিজ উদ্বোধন করা হয়েছে, ঢাকায় কমপ্লেক্স হয়েছে, অনেক কালভার্ট হচ্ছে। একটি মন্ত্রণালয়, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদ হয়েছে। কিন্তু তারপরও পাহাড়ি মানুষের মনে শান্তি নেই। ২৫ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন জেলা পরিষদ পরিচালনার জন্য কোনো বিধি হয়নি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র নাথ সরেন, অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ তারেক, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের দপ্তর সম্পাদক মনিরা ত্রিপুরা, একই সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক টনি ম্যাথিউ চিরান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিপন ত্রিপুরা প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন মেইনথিন প্রমিলা।