৩৭ বছরের জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছেন। দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছেন। চাকরি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন। সংসার হয়েছে, ভেঙেছে। নতুন সম্পর্কে জড়িয়েছেন। শারীরিক নির্যাতনের কারণে সেই সম্পর্কের ইতি টেনেছেন। কিন্তু দুর্ভোগ পিছু ছাড়েনি। সাবেক প্রেমিক দলবদ্ধভাবে তাঁকে ধর্ষণ করেছেন। নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে ওই নারী বলেন, ‘আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, সে সম্পর্ক শেষও হয়েছে। তাই বলে দলবল নিয়ে ধর্ষণ করবে, কল্পনাও করিনি। আমি নিকৃষ্ট মেয়ে হতে পারি, তাই বলে আমার সঙ্গে এই কাজ (ধর্ষণ) করবে! হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেও মাফ পাইনি।’
গত শুক্রবার (২৮ জুন) রাতে রাজধানীর খিলক্ষেতের বনরূপা এলাকায় স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ওই নারী। ধর্ষণের আগে ওই নারীকে দল বেঁধে রড দিয়ে পেটানো হয়। গলা টিপে ধরে হত্যার চেষ্টা করেন সাবেক প্রেমিক।
আজ সোমবার দুপুরে রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় বসে ওই নারীর (৩৭) সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি একটি বেসরকারি সংস্থায় মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হলে চাকরি চলে যেতে পারে, সেই ভয়ে তিনি অফিসে সবকিছু গোপন রেখেছেন। এ জন্য শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও আজ অফিসে এসেছেন। দুপুরে খাবারের বিরতিতে কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে।
এ ঘটনায় সাত আসামির সবাইকে গ্রেপ্তার করেছে খিলক্ষেত থানা-পুলিশ। আসামিরা হলেন আবুল কাশেম ওরফে সুমন (৩৭), পার্থ বিশ্বাস (২০), নূর মোহাম্মদ (২০), হাসিবুল হাসান (১৯), রবিন হোসেন (২৮), মীর আজিজুল ইসলাম (২৩) ও মেহেদী হাসান (২২)। ভুক্তভোগী নারী মামলার বাদী। তিনি জানান, সাত আসামির মধ্যে কাশেম ও কম বয়সী তিনটি ছেলে তাঁকে ধর্ষণ করেন। বাকিরা তাঁদের সহায়তা করেন। আর তাঁকে মারধর করেছেন প্রত্যেকে। থানা থেকে তাঁকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে মেডিকেল পরীক্ষা করিয়েছে পুলিশ।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খিলক্ষেত থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নামুল হক খন্দকার বলেন, আসামিদের গতকাল আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ভুক্তভোগী নারীর মেডিকেল পরীক্ষা করার পর গতকাল রোববার বিকেলে তাঁকে স্বামীর হেফাজতে দিয়ে দেওয়া হয়।
জীবনে ভাঙা-গড়ার গল্প
ভুক্তভোগী নারীর বাড়ি উত্তরাঞ্চলের একটি জেলায়। তিনি জানান, তাঁর বাবা গত বছর মারা গেছেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। ২০১০ সালে কলেজে পড়ার সময় প্রেম করে বিয়ে করেন। উচ্চমাধ্যমিক পাস স্বামী সাভারে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। বিয়ের পর তিনিও পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। চাকরি করা অবস্থায় নিজ জেলার একটি কলেজ থেকে অনিয়মিত ছাত্রী হিসেবে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। বিএ দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ২০১৫ সালে কন্যাসন্তানের মা হন। সে সময় তিনি পোশাক কারখানার চাকরি ছেড়ে রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনীতে নির্দিষ্ট মেয়াদে বেসরকারি সদস্য হিসেবে যোগ দেন। কর্মস্থল ছিল পার্বত্য অঞ্চলে। তাঁর মেয়ে গ্রামে নানির কাছে বড় হতে থাকে। আর স্বামী তাঁকে ছেড়ে আরেকটি বিয়ে করেন। এরপর স্বামীর সঙ্গে তিনি আর যোগাযোগ রাখেননি। ২০১৭ সালে ওই বাহিনীতে কাজের মেয়াদ শেষ হলে তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। তবে মাঝেমধ্যে ঢাকার অদূরে ভাইয়ের বাসায় আসা-যাওয়া করতেন। ২০১৯ সালে ওই বাহিনীতে আবার ডাক পান। এবার কর্মস্থল হয় গাজীপুরে। ২০২১ সাল পর্যন্ত কাজ করার পর অল্প কিছুদিন আরেকটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তারপর আবার গ্রামে ফিরে যান। এই সময়ের মধ্যে ২০১৯ সালে পরিচয় হয় এই ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি আবুল কাশেমের সঙ্গে।
‘কাশেম মাদকাসক্ত, টাকার জন্য নির্যাতন করতেন’
আবুল কাশেমের সঙ্গে পরিচয় তাঁর জীবনের একটি বড় ভুল বলে মনে করেন ওই নারী। তিনি বলেন, পোশাক কারখানায় কাজ করার সময় এক নারী সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। সেই নারী সহকর্মীর বোনের সঙ্গেও সখ্য থেকে প্রায়ই তাঁর বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। ওই বোনের বাড়ি খিলক্ষেত থানার কাওলা এলাকায়। ওই বোনের পাশের ঘরে ভাড়া থাকতেন কাশেম। তাঁর পেশা কী জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, ‘বলত গাড়ি চালায়। তবে বাসের চালক নাকি হেলপার ছিল, বলতে পারব না। তেমন কোনো কাজ করত না।’ কাশেমের তখন স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। কাশেমের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার কিছুদিন পর ওই রাষ্ট্রীয় বাহিনী থেকে ডাক এলে ভুক্তভোগী নারী গাজীপুরে চলে যান। কাশেমও সেখানে যান। একটি ভাড়া করা কক্ষে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করতেন তাঁরা। এ বিষয়ে ওই নারী বলেন, কাশেমকে বিয়ে করতে বললে রাজি হতেন না। কিন্তু নিজের পরিবারে তাঁকে স্ত্রী বলে পরিচয় দিতেন। তিনি কাশেমের সঙ্গে বেশ কয়েকবার তাঁর গ্রামের বাড়িতে গেছেন। কিন্তু মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে কাশেমের সঙ্গে বসবাস করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। ওই নারী গালে একটা পুরোনো ক্ষত দেখিয়ে বলেন, ‘একবার বেতন পাওয়ার পর কাশেম নেশার জন্য টাকা চাইছিল। টাকা দিতে চাইনি বলে ব্লেড দিয়ে গাল কেটে দেয়। এমন দাগ আমার সারা শরীরে। ওর খুব টাকার লোভ ছিল।’
ওই নারী বলেন, দুই বছরের সম্পর্ক শেষ করে ২০২১ সালে তিনি গ্রামের বাড়িতে চলে যান। কিন্তু কাশেম ফোন করলে তিনি কথা বলতেন। এরপর গত ফেব্রুয়ারির আগপর্যন্ত কাশেমের সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি।
ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি
ভুক্তভোগী নারী বলেন, এ বছর তিনি ঢাকার অদূরে একটি বাসা ভাড়া নেন। মেয়েকে গ্রামের বাড়ি থেকে এনে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ফেব্রুয়ারি মাসে কাশেম তাঁর এক বোনের বাড়িতে ডাকলে তিনি দেখা করতে যান। সেখানে তাঁদের শারীরিক সম্পর্ক হয়। কাশেম যে সেটি গোপনে ভিডিও করেছেন, তা তিনি জানতেন না। তিনি চলে আসার পর কাশেম তাঁকে ফোনে বলেন, যদি তাঁকে ৩০ হাজার টাকা না দেন, তাহলে ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেবেন। কাশেম টাকা চেয়ে বারবার ফোন করতে থাকলে তিনি ফোন ধরা বন্ধ করে দেন। শেষ গত ১৮ জুন তিনি আবার বিয়ে করেন। ঘটনার দিন ২৮ জুন তিনি কাওলায় সাবেক সহকর্মীর সেই বোনের বাড়িতে স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে যান। সেখান থেকে বিমানবন্দরে এক ব্যক্তির সঙ্গে একটি কাজে দেখা করে দুজন মিলে হেঁটে হেঁটে ঘুরতে থাকেন এলাকাটিতে।
ওই নারী বলেন, রাত সাড়ে ৯টার দিকে বনরূপা এলাকায় ঘোরার সময় কাশেমকে আরও তিনজন ছেলের সঙ্গে দেখতে পান। তিনি কাশেমকে এড়াতে স্বামীর সঙ্গে দ্রুত হাঁটতে থাকেন। কিন্তু ওই চারজন তাঁদের স্বামী-স্ত্রীকে টেনেহিঁচড়ে ঝোপের দিকে টেনে নিয়ে যান। ওই সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে আরও তিনজন ছেলে নেমে এসে ওই চারজনের সঙ্গে যোগ দেন।
তিনি ওই এলাকায় গেছেন, সেটা কাশেম কীভাবে জানলেন, জানতে চাইলে ওই নারী বলেন, ‘আমার কোনো ধারণা নেই। সে কীভাবে খোঁজ পেল, আমি জানি না। কে জানাল বলতে পারব না।’ এরপরের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আশপাশে কোনো লোকজন ছিল না। রড দিয়ে তাঁকে ও তাঁর স্বামীকে পেটাতে থাকেন আসামিরা। রাত ১২টার দিকে তিনি একটি মোটরসাইকেলের শব্দ পান। ঝোপের কাছে মোটরসাইকেলের আরোহী থেমে একটা ঢিল ছুড়ে চলে যান। কেউ তাঁদের বাঁচাতে আসেননি। নির্যাতনের মধ্যে কাশেম বলেন, তিন লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দেবেন। টাকা নিয়ে দর–কষাকষিতে ৭০ হাজার টাকায় রাজি হন। তাঁকে জিম্মি রেখে আসামিরা তাঁর স্বামীকে ছেড়ে দেন টাকা আনার জন্য। পরে তিনি স্বামীর কাছ থেকে শুনেছেন, স্বামী জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করার পর খিলক্ষেত থানা থেকে পুলিশ আসে। তারা তাঁর স্বামীকে নিয়ে ওই ঝোপের কাছে গিয়ে দেখে, কেউ নেই। তারা ওই এলাকা তন্ন তন্ন করে খোঁজে। রাত দুইটার দিকে ওই সাত আসামির একজনকে রাস্তায় দেখে তাঁর স্বামী চিনতে পারেন। পুলিশ ওই আসামিকে ধরলেও তিনি নির্দিষ্ট ঠিকানায় না এনে পুলিশকে ঘোরাতে থাকেন।
ওই নারী বলেন, একাধিকবার তাঁকে নিয়ে স্থান পরিবর্তন করেন কাশেমরা। রাত সাড়ে তিনটার দিকে তাঁর গলা টিপে ধরেন কাশেম। তিনি ধর্ষণ ও হত্যার কথা বললে সেখানে থাকা অপর ছয় আসামির দুজন বাধা দেন। ওই দুজন বলেন, জিম্মি করে টাকা আদায় করা হবে, সে জন্য তাঁরা এসেছেন। ধর্ষণ ও হত্যার মধ্যে তাঁরা থাকবেন না। ওই নারী বলেন, তিনি হাতে-পায়ে ধরেন ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে। কম বয়সী তিনজনকে বলেন, ‘তোমরা আমার সন্তানের বয়সী’। কিন্তু তাঁরা ভ্রুক্ষেপ করেননি। ওই নারী বলেন, স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাবেন এবং টাকা দেবেন বলার পর কাশেম ভোর পাঁচটার দিকে তাঁকে ছেড়ে দেন। তিনি ওই সময় হাঁটতে হাঁটতে খিলক্ষেতে একটি সেতুর কাছে এসে এক নিরাপত্তাকর্মীর মুঠোফোন থেকে স্বামীকে ফোন করেন। তখন স্বামী ও পুলিশ সদস্যরা এসে তাঁকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান।
এ ঘটনায় কাশেম ও তাঁর সহযোগীরা যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পান, তা নিশ্চিতের দাবি জানান ভুক্তভোগী ওই নারী।
ঢাকা