‘আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করিব….’

0
190

মাসখানেক আগে কুড়িগ্রাম গিয়েছিলাম একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের বাইরে সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁদের কেউ আওয়ামী লীগের সমর্থক, কেউ বিএনপির সমর্থক, আবার কেউবা নিঃসঙ্গ বামধারার পতাকা ধরে আছেন। আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁরা জানালেন, কুড়িগ্রামে রাজনৈতিক হানাহানি নেই। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে যে যাঁর কর্মসূচি পালন করেন, সমস্যা হয় না। এক দলের নেতারা অন্য দলের কোনো নেতা-কর্মী বিপদে পড়লে এগিয়েও আসেন। শত শত বছর তাঁরা একসঙ্গে বাস করে আসছেন, কখনো এক পাতে খানও। সবকিছু দলীয় চশমা দিয়ে দেখতে চান না তৃণমূলের এসব নেতা-কর্মী।

ঢাকায় বসে যেসব বড় নেতা বক্তৃতা-বিবৃতিতে হরহামেশা প্রতিপক্ষকে তুলাধোনা করেন, তাঁরা তৃণমূলের, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভাষাটা বোঝেন বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের কথাবার্তায় মনে হয়, তাঁরা একুশ শতকের শেষ দিন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। কেউ ক্ষমতা থেকে নামাতে পারবেন না। অন্যদিকে বিএনপির বড় নেতারা কর্মী-সমর্থকদের এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে তাঁরা ক্ষমতায় এসেই গেছেন। আওয়ামী লীগের বিদায়ঘণ্টা বেজে গেছে।

১৯ জুন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিএআই) জাতীয় পর্যায়ে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছিল। এতে সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রীরা ছিলেন। ছিলেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী মোর্চার অংশীজন, বাম ও ইসলামি ধারার নেতারাও।  সভায় একটি বিষয় লক্ষ করলাম, বামদের মতো ইসলামি ধারার নেতারাও নিজেদের আওয়ামী ও বিএনপির শিবিরে ভাগ করে নিয়েছেন। রাজনীতিকদের বাইরে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, কূটনীতিক, সাংবাদিক, নির্বাচনবিশেষজ্ঞরাও আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।

সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হলেও মূল বিষয় ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা সংকটের জন্য একে অপরকে দায়ী করেছেন। এক পক্ষ সংবিধান থেকে একচুলও নড়বেন না বলে জানিয়ে দিয়েছে। আরেক পক্ষ বলেছে, দলীয় সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন হবে না। তাদের কণ্ঠে সমঝোতার কোনো আভাস ছিল না। তাঁদের কথা হলো, ‘আলোচনা মানি; কিন্তু তালগাছটি আমার।’

তাহলে সমাধান আসবে কীভাবে? সংঘাতে! পৃথিবীর আর কোনো দেশে নির্বাচন নিয়ে এত আলোচনা, এত বিতর্ক, এতবার সংবিধান অদলবদল হয়েছে, আমাদের জানা নেই। আমাদের নেতা-নেত্রীরা ঘুম থেকে উঠে নির্বাচনের কথা বলেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগেও। কিন্তু একটি সুষ্ঠু ভোট কীভাবে হতে পারে, সে বিষয়ে তাঁরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেন না। বিরোধী দলে থাকতে তাঁরা যা বলেন, ক্ষমতায় গিয়ে ঠিক তার উল্টোটা বলেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির মধ্যে এই একটি বিষয়ে শতভাগ মতৈক্য আছে।

আলোচনায় অংশগ্রহণকারী নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সংকট সমাধানের জন্য সংলাপের ওপরই গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা সরকারি ও বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, আপনারা দয়া করে আলোচনায় বসুন। একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে।  বর্তমানে দেশে একদিকে ডলার ও জ্বালানিসংকট, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত; এ অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে আরেকটি সংঘাতময় পরিস্থিতি জনজীবনে মহা বিপর্যয় ডেকে আনবে।

ঢাকায় বসে সরকারি ও বিরোধী দলের বড় নেতারা ভাবেন, প্রতিপক্ষের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। আগে সামাজিক অনুষ্ঠানে বিবদমান দলের নেতা-কর্মীদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো, এখন সেটাও তাঁরা এড়িয়ে চলেন। কিন্তু তৃণমূলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গ এড়াতে পারেন না। ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে তাঁদের দেখা হয়। এমনকি এক দলের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হলে অপর দলের সমর্থক আইনজীবী সাধ্যমতো সহায়তা করেন।

জাতীয় সংলাপের আগে বিইআই মে মাসে ময়মনসিংহ, বগুড়া, রংপুর ও ফরিদপুরে (ঢাকা বিভাগ) চারটি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। এসব সভায় স্থানীয় রাজনীতিক, সংস্কৃতিসেবী, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমে প্রতিনিধি অংশ দেন। তারা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট, যদিও বৈষম্য সমাজের বৃহত্তর অংশকে পীড়িত করে। তারা চান অতীতের হিংসা বিদ্বেষ পেছনে ফেলে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কল্যাণে কাজ করুক। নিয়ত ঝগড়াঝাঁটি না করে দেশের উন্নয়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করুক।

তৃণমূলের প্রতিনিধিরা যেসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সেগুলো হলো গণতন্ত্রচর্চা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে যাওয়া, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা কমে যাওয়া এবং দুর্নীতি বেড়ে যাওয়া। রাজনীতিতে অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব নিয়েও তারা চিন্তিত।

তবে তাদের বেশি উৎকণ্ঠার বিষয় হলো, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হওয়া। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যেমন হয়রানির ভয় আছে, তেমনি সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রতিঘাতের আশঙ্কা আছে। তাঁদের আলোচনায় আরও এসেছে, জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অনাস্থা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন আস্থার সংকট আছে, তেমনি তাদের প্রতি সাধারণ মানুষও আস্থা রাখতে পারছে না।

সরকার খুশি, বিএনপিও খুশি, মন খারাপ পাবলিকের

যে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের জন্য রাজনীতি করছে, তাদের প্রতি সেই জনগণ আস্থা রাখতে পারছে না। তবে তৃণমূলের প্রতিনিধিরা আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনী সমস্যা সমাধান ও  রাজনৈতিক বিভাজন কমানোর পক্ষে মত দিয়েছেন।

বিএআইয়ের উপস্থাপনায় কেবল রাজনীতি নয়, পাঁচ দশকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জনও উঠে এসেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাইনাস ৫ দশমিক ৮৪, ২০২১ সালে সেটি দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে এবং বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলো ৭ দশমিক ১ শতাংশ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ছিল ১২৮ মার্কিন ডলার। বর্তমানে ২ হাজার ৭৯৩ ডলার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৮, বর্তমান প্রায় ৭৪ শতাংশ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৬ বছর, বর্তমান ৭২ দশমিক ৩ বছর। ২০২২ সালে বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ৪২ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যা পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এসব অর্জনকে রাজনৈতিক সংঘাতে তাঁরা হারাতে দিতে চান না।

ঢাকায় বসে সরকারি ও বিরোধী দলের বড় নেতারা ভাবেন, প্রতিপক্ষের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। আগে সামাজিক অনুষ্ঠানে বিবদমান দলের নেতা-কর্মীদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো, এখন সেটাও তাঁরা এড়িয়ে চলেন। কিন্তু তৃণমূলে যাঁরা থাকেন, তাঁদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গ এড়াতে পারেন না। ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে তাঁদের দেখা হয়। এমনকি এক দলের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হলে অপর দলের সমর্থক আইনজীবী সাধ্যমতো সহায়তা করেন।

যদি ’১৪ ও ’১৮ সালের মতো নির্বাচন না হয়?

বিএইর আয়োজনের খবর পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ রাজ্জাক চিঠি লিখেছেন, যা একইভাবে আবেগমিশ্রিত ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত।  বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের এই সদ্য সাবেক প্রচার সম্পাদক লিখেছেন, ‘জীবন বাজি রাখিয়া মুক্তিযুদ্ধ করিয়াছি, দেশকে প্রাণাধিক ভালোবাসি বিধায়। নির্বাচন নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজা সময়ের দাবি। দেশ অনেক উন্নত হইয়াছে, সারা বিশ্বের নিকট সম্মানিত হইয়াছে, পরিচিত হইয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্র দরকার। গণতন্ত্র নিয়ে অনেক দুর্নামও আছে। আমরা বিদেশিদের হাতে পুতুল না হইয়া আমাদের সমস্যা আমরা সমাধান করিতে বদ্ধপরিকর হওয়া উচিত। তাই, আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধারা এই বিষয়ে ভূমিকা রাখিতে আগ্রহী।’

এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আকুতি এবং তৃণমূলের মানুষের ভাষা কেন আমাদের ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনীতিকেরা শুনতে পান না?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি।
  • ইমেইল: sohrabhassan55@gmail.com

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.