বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া নাতনি তাসফিয়া জাহানকে (ঋতু) হারিয়ে পাগলপ্রায় তাঁর বৃদ্ধ নানা-নানি। নাতনির শোকে বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা। পাড়াপড়শির কোনো সান্ত্বনাই মানতে পারছিলেন না তাঁরা। বারবার বলছিলেন ‘ওর মা-বাপরে কী জবাব দেব, কী সান্ত্বনা দেব এখন?’
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) লেকে ডুবে মারা যান দুই শিক্ষার্থী মোবাশ্বেরা তানজুম ও তাসফিয়া জাহান। দুজনই পরিবেশবিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁরা দুজন বন্ধু ও রুমমেট।
তাসফিয়া জাহানের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর হলেও ছোটবেলা থেকেই নানাবাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের মাসকাটা গ্রামে নানা-নানির কাছে বড় হয়েছেন। গতকাল দুপুরে ক্যাম্পাসে তাঁর মৃত্যুর পর সন্ধ্যার আগে তাসফিয়ার লাশ আনা হয় সেই মাসকাটা গ্রামে।
বেতাগা ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নাতনির মৃত্যুর খবরে নানা-নানি দুজনই পাগলপ্রায়। কাঁদতে কাঁদতে কয়েকবার জ্ঞানও হারিয়েছেন তাঁরা। তাসফিয়ারা দুই বোন। বড় মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে চাঁদপুর থেকে রওনা দিয়েছেন তাঁর বাবা আবদুর রব ও মা রুমা বেগম। তাঁরা পৌঁছালে আজ বুধবার নানাবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাসফিয়ার মা–বাবা তাঁর ছোট বোনকে নিয়ে চাঁদপুরে থাকেন। ছোটবেলা থেকে নানা-নানির আদরযত্নে বড় হওয়ায় তাঁরাই ছিলেন তাঁর সব। ২০১৭ সালে ফকিরহাটের বেতাগা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৯ সালে খুলনার বয়রা মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তাসফিয়া। এরপর গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
তাসফিয়ার নানা এবারত আলী বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্টে ঋতুকে বড় করেছি। কোনো দিন বাবা-মায়ের অভাব বুঝতে দিইনি, এখন আমাদের রেখেই চলে গেল ও। এখন কে আমাকে নানা বলবে? কে বলবে, পড়াশোনা শেষে চাকরি পেলে তার সঙ্গে থাকার কথা?’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃদ্ধ এবারত আলী।
তাসফিয়ার নানি হাওয়া বেগম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে ঋতুকে আগলে রেখেছি। ও নিজের পায়ে দাঁড়াবে, সবাইকে দেখে রাখবে, সেই স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু এভাবে চলে গেল! কী জবাব দেব আমি ওর মা-বাবাকে?’
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বৃষ্টিতে ভিজছিলেন দুই সহপাঠী মোবাশ্বেরা তানজুম ও তাসফিয়া জাহান। একটি লেকের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যান সাঁতার না-জানা মোবাশ্বেরা। তাঁকে বাঁচাতে লেকের পানিতে ঝাঁপ দেন তাসফিয়া। দুজন ওপরে উঠতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তাঁরা পানিতে ডুবে যান। ঘটনাটি দূর থেকে দেখতে পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী এসে পানিতে ঝাঁপ দেন। প্রায় ৩০ মিনিট পর তাঁদের উদ্ধার করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তাঁদের গোপালগঞ্জের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার আগেই দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানান চিকিৎসক।