‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমি বসবাস করি, কিন্তু এটাতে মরতে রাজি নই। এমন পৃথিবী দেখতে চাই না, যেখানে অধিকার নির্ধারিত হবে ক্ষমতায় এবং শর্তসাপেক্ষে স্বাধীনতা। আমি এমন ভবিষ্যতে বিশ্বাসী, যেখানে প্রতিটা মানুষের কথা বলার অধিকার থাকবে, পছন্দ থাকবে এবং থাকবে নিজেদের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার—যা কেড়ে নেওয়ার অধিকার কেউ রাখবে না।’ আজ শনিবার ফেসবুকে এমন একটি পোস্ট দিয়েছেন অভিনয়শিল্পী আজমেরী হক বাঁধন।
মাঝখানে বেশ কিছুদিন ফেসবুকে অনিয়মিত ছিলেন বাঁধন। এখন আবার নিজের চিন্তাভাবনার কথা লিখছেন। আজ শনিবার হঠাৎ করে ফেসবুকে এমন পোস্ট দেওয়ার পেছনের কারণ জানতে চাইলে বাঁধন দুপুরে প্রথম আলোকে বললেন, ‘এটা আমার আজকের উপলব্ধি নয়। সব সময়ের। এমন সমাজেই কিন্তু আমরা বসবাস করি। বড় হয়েছি। এ ধরনের পরিবারে আমি বেড়ে উঠেছি। এমন নয় যে আমার পরিবার খুবই প্রোগ্রেসিভ চিন্তাভাবনার। আমার পরিবারও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার একটা অংশ। আমার পরিবার, আমার বাচ্চা, বাচ্চার বাবা—সব মিলিয়ে এমন উপলব্ধি।’

সন্তানের বাবার কথা বলছিলেন। আপনার বাবা কোন ধরনের মানসিকতা পোষণ করেন, এমন প্রশ্নে বাঁধন বললেন, ‘আমার বাবাও এই সমাজব্যবস্থারই অংশ।’
কীভাবে এখান থেকে উত্তরণ সম্ভব, জানতে চাইলে বাঁধন বললেন, ‘আমাদের চারপাশে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা প্রচুর আছে। আছে আইনি প্রতিবন্ধকতাও। এসব দূর করতে হবে সবার আগে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়টা সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্রের উচিত, সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের পথ দেখানো। এরপর মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা সম্পূরক। সত্যি বলতে, নারী সংস্কার কমিশনে যে প্রস্তাব রয়েছে, তা আমি জানি এবং সেগুলোর বেশির ভাগের সঙ্গে আমি একমত। এগুলোর প্রয়োগে সমাজে ইতিবাচক কিছু ঘটবে বলে বিশ্বাস করি।’

কথা প্রসঙ্গে বাঁধন বললেন, ‘আমার মনে হয়, প্রত্যেকটা মেয়ে প্রতিটা মুহূর্তে অনুভব করে, তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। হচ্ছেও। নারীদের দমিয়ে রাখার এই চেষ্টা হয়ে আসছে সব সময়। আগে হয়তো কেউ বলত না সেভাবে, এখন সমস্যাগুলো প্রকাশ্যে আসছে। নারী তার অধিকার চাচ্ছে, আবার মানুষেরাও নারীর প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করছে। আমি চাই যে আমার মেয়ে এই দেশের আলো–বাতাসে বেড়ে উঠবে। আমার জীবদ্দশায় দেখতে চাই, আমাদের দেশটা সাম্যের, সৌহার্দ্যের, সম্প্রীতির হবে। নারী-পুরুষ বা অন্য কোনো লিঙ্গের মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। মানুষকে মর্যাদা দেওয়া হবে। মানুষ তার অধিকার পাবে। স্বাধীনতা পাবে। আমিও আশা করি, সেই সমাজ আমরা পাব।’

নারীর প্রতি বিদ্বেষের বিষয়টি বাঁধন আশপাশে যেমন দেখতে পান, তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি দেখে থাকেন, কথা প্রসঙ্গে তা–ই জানালেন।
বাঁধন বললেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাকে অনেকে বলে, মন্তব্যের ঘর বন্ধ করে রাখতে; কিন্তু আমি তা করিনি। করতে চাইও না। আমাকে অনেকে এ–ও বলেছে, এত বাজে বাজে মন্তব্য। কুৎসিত সব কথাবার্তা। বিকৃত মন্তব্য—পড়ে দেখলে বোঝা যায়। আমি বন্ধ করি না আসলে এই কারণে, আমরা কোন সমাজব্যবস্থায় বাস করি, সেটার একটা প্রতিপলন এই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। মানুষ কী চিন্তা করছে, প্রকাশ্যে বলতে না পেরে অনেকে ফেক আইডি দিয়ে ফেসবুকে লিখছে। মানুষের প্রতি বিদ্বেষ, বিশেষ করে নারীর প্রতি বিদ্বেষ সেটি প্রকাশ করছে। এসব আমি দেখতে চাই। প্রমাণও রেখে দিতে চাই যে কেমন সমাজে বাস করি।’

ভার্চ্যুয়াল জগতে হয়রানি রোধে সরকারের আলাদা একটা সংস্থা আছে। সেখানেও তো প্রতিকার চাইতে পারেন, এমন প্রসঙ্গ তুলতেই বাঁধন বললেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্যি হচ্ছে, সাইবার অপরাধ বিভাগ থেকে এ ধরনের অপরাধে এখন পর্যন্ত কাউকে কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে বলে আমি শুনিনি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কাউকে দিলে হয়তো এ ধরনের অপরাধ কিছুটা হলেও কমত। পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগে আগে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের অনেকেই ক্রাইমে জড়িত ছিলেন। তাঁরাই নানা রকম হ্যারেসমেন্ট আমাদের করেছেন। বিশেষ করে আমি তো হয়েছি। তাই আমি খুব বেশি একটা আশাবাদী নই। আমাদের এখানে একটা মেয়েকে গালি দিচ্ছে বা নায়িকাকে গালি দিচ্ছে—এটা যেন একটা শ্রেণির মানুষের অধিকার। যারা এসব অপরাধ ভার্চ্যুয়াল জগতে করছে, তারা ধরেই নিচ্ছে, নারীকে গালি দেওয়াই যায়। তবে কিছু মানুষ আছে ভালো। তারা বড় হয়েছে ভালো মানুষ হিসেবে, সুন্দর পরিবেশে। আমি ভাবতে পারি না, সমাজের বেশির ভাগ মানুষের মানসিকতা যদি এমন হয়, তাহলে সমাজ কতটা এগোবে, তা নিয়ে আমি শঙ্কিত।’