আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় মামলা নিয়ে পুলিশের লুকোচুরি

0
55
আবু সাঈদ

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবু সাঈদ গুলিতে নিহতের ঘটনায় মামলা দায়ের এবং তদন্ত নিয়ে লুকোচুরি করছে পুলিশ। ঘটনার ১০ দিন পার হলেও বিষয়টি পরিষ্কার করেনি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। তাদের তদন্ত কমিটির কাজও চলছে ঢিমেতালে। গুলির ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে একজন সাব-ইন্সপেক্টরের (এসআই) নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এলেও তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তারা তাঁর ব্যাপারে তথ্য দিতে নারাজ।

গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সংঘর্ষের সময় গুলিতে মারা যান আবু সাঈদ। পরদিন রংপুর মেট্রোপলিটনের তাজহাট থানায় এ ব্যাপারে একটি মামলা হয়।

বাদী তাজহাট থানার (বেরোবি) পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এসআই বিভূতি ভূষণ রায়। পেনাল কোডের (১৪৩/১৮/৬/৩৩২/ ৩৩৩/৩৫৩/৩৭৯/৪৩৫/ ৪২৭/৩০২/৩৪) ধারায় মামলাটি করা হয়। বিবরণে উল্লেখ রয়েছে, বেআইনি জনতা সাধারণ/মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করে গুরুতর জখম, চুরি, ভাঙচুর, ক্ষতিসাধন, অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ ছাত্রকে হত্যা করার মতো অপরাধ। আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ না থাকলেও এতে বলা হয়, এরা উচ্ছৃঙ্খল ২-৩ হাজার আন্দোলনকারী ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্ত। তাদের সঙ্গে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির সমর্থিত নেতাকর্মীও রয়েছে।

ঘটনা সম্পর্কে মামলায় বলা হয়, ওই সময় পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখা যায়। তখন তাঁর সহপাঠীরা তাঁকে ধরাধরি করে জরুরি চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মৃত ছাত্রের নাম আবু সাঈদ (২৩)। তাঁর পিতা-মকবুল হোসেন এবং বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জের বাবনপুর জাফরপাড়ায়।

সাধারণ ছাত্ররা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ মারা গেলেও এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সুস্পষ্ট মামলা হয়নি। উল্টো নিজেদের দোষ ঢেকে পুলিশ দায়ী করেছে আন্দোলনকারীদের। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন– প্রকাশ্যে বুকে গুলির যে ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সারা বিশ্ব দেখল, সেটি কি তাহলে মিথ্যা! তাছাড়া, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না, ভিডিও দেখলে তার প্রমাণ মিলবে।

সমকালের সঙ্গে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তির কথা হয়। তারা বলেন, গত ১৬ জুলাই দুপুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিছিলে অংশ নেন আবু সাঈদ। কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। মিছিলের সামনে থেকে তিনি নেতৃত্ব দেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলটি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাধা দেয়। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাধে। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। এ সময় শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। আবু সাঈদ একা দাঁড়িয়ে তা মোকাবিলার চেষ্টা করেন। বুক উঁচিয়ে দেওয়া আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। রংপুর মেডিকেলে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানান, সাঈদের শরীরে শতাধিক গুলির ক্ষত ছিল।

আন্দোলনে থাকা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও আবু সাঈদের সহপাঠী আব্দুস সাফি, মো. রিপন ও মো. শিহাব বলেন, ‘এখন সর্বত্র স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা নিয়ে আলোচনা। অথচ চোখের সামনে আবু সাঈদসহ কত তাজা প্রাণ ঝরে গেল, সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলছেন না। এটা দুঃখজনক। পুলিশ আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করলেও এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট মামলা হয়নি।’ কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞের নিন্দা জানিয়ে তারা বলেন, ‘এ ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি হোক। তবে আবু সাঈদসহ নিহত শিক্ষার্থীদের খুনিদেরও আইনের আওতায় আনা হোক।’

আবু সাঈদকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ। তিনি বলেন, ‘হাত, বুক, পিঠ, মুখসহ সাঈদের শরীরের শতাধিক স্থানে বুলেটের আঘাতের চিহ্ন ছিল। মাথার পেছনে ফুটো হয়ে রক্ত ঝরছিল।’ সাঈদের শরীর ঝাঁজরা করে দেওয়া সেই পুলিশের বিচার দাবি করে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে পুলিশের লুকোচুরির ঘটনা রহস্যজনক। পুলিশের সেই কর্মকর্তাকে কী শাস্তি দেওয়া হয়েছে, জনগণ তা জানতে চায়।’

বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক তাবিউর রহমান প্রধান বলেন, ‘আবু সাঈদ নিহতের ঘটনা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। অথচ এ ঘটনায় সুস্পষ্ট মামলা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট মামলা করেনি। আমরা এতে হতাশ। আমরা ছাত্র হত্যার বিচার চাই।’

নিহত আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। মামলা-মোকদ্দমা চালানোর মতো আর্থিক বা সামাজিক অবস্থা আমার নেই। আমার ছেলে তো দুনিয়াতে নেই। আমি চাই, ছেলের খুনি সেই পুলিশকে বিচারের আওতায় আনা হোক।’ ‘আর কেউ না করলেও আল্লাহ নিশ্চয় বিচার করবেন’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আবু সাঈদ নিহত ও বিশ্ববিদ্যালয় গেটে সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে পুলিশ। কমিটির প্রধান রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) সায়কুজ্জামান ফারুকী। সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু ঘটনার ১০ দিন পরও কমিটি প্রতিবেদন দিতে পারেনি।

এ ব্যাপারে সায়ফুজ্জামান ফারুকী বলেন, ‘তদন্তকাজ শেষের দিকে। আগামী রোববার নাগাদ প্রতিবেদন দাখিল করা যেতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় পুলিশ সদস্য বা অন্য যেই দোষী সাব্যস্ত হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ ভিডিও দেখে তদন্তকাজ চলছে বলে জানান তিনি।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মতিউর রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটিকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারাও এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। কমিটির প্রধান বলেন, ‘তদন্ত চলমান, শিগগির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘রংপুরের পরিস্থিতি পুলিশ ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। ১৪ মামলায় এ পর্যন্ত প্রায় দেড়শজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। টিভি ফুটেজ দেখাসহ নানাভাবে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হয়েছে।’ আবু সাঈদ নিহতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সংঘর্ষের ঘটনার পরপরই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ওই ঘটনার জন্য যেই দায়ী হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাজহাট থানার এসআই জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা সবাই স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী। অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

আবু সাঈদকে গুলির ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসআই ইউনুছ আলীর নাম এসেছে। অনেক চেষ্টা করেও গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোন বন্ধ। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তারাও তার ব্যাপারে তথ্য দিতে রাজি হননি। তবে জানা গেছে, তার গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা শ্রীরামপুর ইউনিয়নের দাঙ্গাপাড়া গ্রামে। চাকরি সূত্রে পরিবার নিয়ে থাকে রংপুর শহরে। ঘটনার পর পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে।

ইউনুছ আলীর ভাতিজা জুয়েল রানা বলেন, ‘আমার চাচা ষড়যন্ত্রের শিকার। তার চেহারার অন্য কেউ এই গুলির ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে।’

আবু সাঈদ ছিলেন মা-বাবার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তান। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি একা লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। স্থানীয় খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন আবু সাঈদ। পরে রংপুর সরকারি কলেজ থেকে একই ফল নিয়ে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে। এই বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি।

আবু সাঈদের পরিবারকে সহায়তা দিল বেরোবি 
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) প্রশাসন। গতকাল আবু সাঈদের মা-বাবার হাতে সাড়ে ৭ লাখ টাকার চেক তুলে দেয় বেরোবির প্রতিনিধি দল। এ সময় আবু সাঈদের বৃদ্ধ বাবা মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরা ছিল আবু সাঈদ। তার প্রাইভেট পড়ানোর টাকায় আমার সংসার চলত। এখন সব শেষ।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মণ্ডল আসাদ প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

প্রক্টর শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ভিসির নির্দেশে আবু সাঈদের বাবা-মায়ের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যোগাযোগ রাখছে। ভিসি স্যার নিজেও সাঈদের পরিবারের খোঁজ রাখছেন, পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে সাড়ে ৭ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’

লিমন বাসার, উত্তরাঞ্চল, স্বপন চৌধুরী, রংপুর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.