আমার ‘ম্যাট্রিক ফেল’ মা জীবনের কঠিন পরীক্ষাগুলোতে অবিশ্বাস্যভাবে পাস করে গেছেন

0
78
রাজীব হাসানের মা শরীফা বেগম, ছবি: সংগৃহীত

অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া উচিত মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত সংসারের মায়েদের। সংসার খরচের টাকায় চাহিদা ও জোগানের যে বিশাল পার্থক্য, তা হলুদের গন্ধমাখা শাড়ির আঁচলে ঘাম মোছার মতোই মুছে দেন তাঁরা। কীভাবে তাঁরা বাঁচিয়ে রাখেন সংসার? আজ বিশ্ব মা দিবসে শোনা যাক এক মায়ের লড়াইয়ের গল্প।

আমাদের বাসায় একবার কিসের যেন জরিপকারীরা এলেন। আম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার ছেলেমেয়ে কয়জন?’ আম্মা উত্তর দিলেন, ‘এই হবে ছয়-সাতটা।’

জরিপকারী থ। জীবনেও এমন উত্তর তাঁরা শোনেননি। কোনো মা নিজের সন্তানের সংখ্যা বলতে গিয়ে বলছে, ‘এই হবে ছয়-সাতটা!’

জরিপকারীরা তো আর জানতেন না, আম্মার ‘ছেলেমেয়ে’র মধ্যে তিনটা ছেলে, এক মেয়ে; পাঁচটা মুরগি, তিন-চারটা পাতিহাঁস, দু-তিনটা রাজহাঁস, কয়েকটা খরগোশ আছে। হিসাব রাখা আসলেই কঠিন!

আম্মা অবশ্য এমনিতেই হিসাব রাখায় খুব দক্ষ ছিলেন না, এখনো নেই। একটা ঘটনা বলি। আম্মার সঙ্গে এক দোকানির দরদাম হচ্ছে—
: এই পাতিলটার দাম কত?
: খালা, ২৪০ টাকা। আপনার জন্য একদাম ২৩০ টাকা।
: কী বলেন, এই পাতিলের দাম এত! ২৫০ টাকা দিব। দিলে দেন, না দিলে নাই।

আমার সেই হিসাব রাখতে না পারা সহজ সরল মা, ‘ম্যাট্রিক ফেল’ মা জীবনের সবচেয়ে বড় কঠিন পরীক্ষাগুলোয় অবিশ্বাস্যভাবে পাস করে গেছেন।

আব্বা যখন পুরোপুরি বেকার, একরকম নিরুদ্দেশ, আম্মা একাই রংপুর শহরে আমাদের টিকিয়ে রেখেছিলেন। কিছুতেই আমাদের গ্রামে নিয়ে যেতে দেননি। জানতেন, গ্রামে গেলে আমাদের আর পড়াশোনা হবে না।

প্রতিবার বাড়িভাড়া বাকি পড়ায় প্রতি দুই-তিন মাসে আমাদের একবার করে বাসা পাল্টাতে হতো। নিজেদের মনে হতো কচুরিপানার মতো। আমরা হয়তো ভেসেই যেতাম। আম্মা তা হতে দেননি। আম্মা আমাদের দিঘির সেই শাপলা কিংবা পদ্মফুলটা বানিয়ে রেখেছিলেন।

যত ঢেউ আর ঝড়ঝাপটা হোক, সংসার নামের অতল গহিন পানিতে আমরা স্থির ভেসে ছিলাম। কারণ, সেই শাপলাকে শক্ত করে বেঁধে রেখে জলের আড়ালের ডুবন্ত শিকড় হয়ে ছিলেন আমাদের ‘ম্যাট্রিক ফেল’ মা। আয়হীন একটা সংসারে কীভাবে আমাদের বড় করেছেন ভেবে পাই না।

অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া উচিত মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত সংসারের মায়েদের। সংসার খরচের টাকায় চাহিদা ও জোগানের যে বিশাল পার্থক্য, তা হলুদের গন্ধমাখা শাড়ির আঁচলে ঘাম মোছার মতোই মুছে দেন মা—দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। এর চেয়ে বড় অলৌকিক অর্থনৈতিক তত্ত্ব আর কী হয়!

আরেকটা ঘটনা বলি।
এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। মানবিক বিভাগ থেকে থেকে স্টার মার্কস পেয়েছি। আগের পরীক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা জানেন, আর্টস থেকে ৭৫০+ মার্কস তোলা কতটা কঠিন ছিল।

তো আমি রেজাল্ট নিয়ে বাসায় ফিরতেই দেখি—মা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। টেনশনে কাঁপছেন। আমি গিয়ে বললাম, ‘স্টার পাইসি, আম্মা।’ আম্মা কেঁদে দিলেন বাচ্চা মেয়ের মতো। আমি ভাবলাম, আবেগে কাঁদছেন। একটু পর ভুল ভাঙল। আম্মা বললেন, ‘বাবা রে, এইটা তুই কী করলি? তোকে নিয়া আমার কত আশা ছিল! ভাবছিলাম, ফার্স্ট ডিভিশনটা অন্তত পাবি…। থাক বাবা, মন খারাপ করিস না।’

আমার মা, আমার বোকাসোকা মা, আমার তেল-নুন-হলুদের গন্ধমাখা আটপৌরে শাড়ি পরে থাকা মা, আমার কারণ-অকারণে বকবক করতে থাকা মা জানতেনই না ফার্স্ট ডিভিশনের চেয়ে স্টার মার্কস আরও বড় কিছু। আমরা ভাইবোনেরা আজীবন চেষ্টা করে গেছি, যেন মায়ের স্বপ্ন পূরণের পরীক্ষায় অন্তত ফার্স্ট ডিভিশন পাই।

দুই.
আমার উপন্যাস ‘আমাদের শহরে বাঘ এসেছিল’ আম্মাকে উৎসর্গ করেছি। অনেকে তাঁর প্রথম বইটা মাকে উৎসর্গ করে। আমি আমার তৃতীয় বই মাকে উৎসর্গ করেছি। তবু দ্বিধায় ছিলাম। এই বই কি আমার মায়ের পায়ে তুলে দেওয়ার যোগ্য হয়েছে? আমার মায়ের জীবনের গল্প লিখব, সেই ভাষা নির্মাণের সাধ্য দুই পয়সার এই লেখককে কেন দিলেন না সৃষ্টিকর্তা!

শেষ মুহূর্তে বইয়ে যুক্ত হওয়া উৎসর্গপত্র:
নিমগাছের ডালে বসে আছে একটা চিল। নিচে ঘুরঘুর করছে একটা মা মুরগি। দানা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে তার চারটে ছানা। মা মুরগি নিজে খায়নি বহুদিন। ডিমে তা দিতে যে হয়েছে একটানা। দানাগুলোয় ঠোকর দিচ্ছে ঠিক, খাচ্ছে না। দেখিয়ে দিচ্ছে, বাছারা, এইভাবে খা।

শাঁ করে উড়ে মাটিতে নামল ভয়ংকর সেই চিল। তীক্ষ্ণ নখের থাবা বাড়িয়ে দিল তুলতুলে ছানাগুলোর দিকে। মা মুরগির শরীরের পাখনাগুলো সব খাড়া হয়ে গেল। গলা উঁচিয়ে তেড়ে গেল চিলটার দিকে। তীব্র চিৎকার করে উঠল…কককক কককক! ভয়ে পালিয়ে গেল চিল।

এই তো মা, আমার মা! আমাদের মা!

তিন.
ঘ্যাচর ঘ্যাচ শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে ত্রিচক্রযান। রিকশায় যাত্রীও তিনজন। আমার বয়স তখন কত? ছয় কি সাত। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে উত্তাল সারা দেশ। সেই আঁচ এসে লেগেছে এরশাদের দুর্গ রংপুরেও। তখন কি আর অত কিছু বুঝি? আমার ভাবনার ছোট্ট জগতে এসবের কোনো বালাই নেই।

কল্পনার সেই জগৎ তখন অন্য কিছুর দখলে। সেখানে আছে রাজপুত্র-রাজকন্যা। পঙ্খীরাজ ঘোড়া। সোনার কাঠি-রুপার কাঠি। আছে রাক্ষস-খোক্কস। সন্ধ্যা হলেই ভূতের ভয়। আছে শাওনদের পেয়ারাগাছ থেকে পেয়ারা চুরির নির্বোধ সাহস। ভোঁকাট্টা ঘুড়ির পেছনে ছুটে ছুটে হয়রান হওয়া। আর? আর আছে একজোড়া চাকাওয়ালা জুতার জন্য অসম্ভব জিদ।

আমাদের পাড়ায় কয়েকজন ছেলেমেয়ে চাকাওয়ালা জুতা পরে কী সুন্দর ছুটে যায়! আমার খুব হিংসা হয় ওদের দেখে। স্কেটিং-মেসকেটিং তো তখন বুঝি না। শুধু বুঝি, নিচে ছোট ছোট চাকা লাগানো থাকে এমন জুতাও পাওয়া যায়, যে জুতা পরে হাঁটতে হয় না! এমনিতেই গড়গড়িয়ে ছুটে যাওয়া যায়। এই জুতাই আমার চাই।

প্রতিদিন মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করি, ‘আম্মা, আমাক চাকাওলা জুতা কিনে দ্যান। দ্যান না।’

সাধারণ লেদারের স্যান্ডেল কেনারই সাধ্য তখন ছিল না। চাকাওয়ালা জুতা মিলবে কোত্থেকে! কিন্তু আমি তো অবুঝ।

মা একদিন নামাজ শেষে আমাকে ডাকলেন। বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন। বললেন, ‘বাবা রে, তোক যে চাকাওলা জুতা কিনি দিবার পারলাম না…।’ মা হয়তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিলেন। সেই না–বলা কথাগুলো চোখের পানি হয়ে ঝরল।

বড় হয়ে এখন বুঝি, মা অলক্ষ্যে আমাদের সবার পায়ে অদৃশ্য চাকাওয়ালা জুতা ফিট করে দিয়েছেন। এ কারণেই তো এখন পথ চলতে পারছি—গড়গড়িয়ে!

রাজীব হাসান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.