গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী বাদে অন্য প্রার্থীরা নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, ভোটের আগে প্রচারপর্বে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি হয়নি। সম্ভাব্য নির্বাচনী এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। ফলে ভোটের দিন পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় বাড়ছে।
এই শঙ্কা আছে সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও। ভোটের পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সোমবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবী প্রতিনিধি, সাধারণ ভোটারের সঙ্গে কথা বলেছে । তাঁরা জানান, আওয়ামী লীগ খুবই গুরুত্ব দিয়ে গাজীপুরে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রার্থীরা প্রচারণার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ করছেন। এসব কারণে নিজের ভোট নিজে দিতে পারা নিয়ে সাধারণের মধ্যে শঙ্কা আছে।
গাজীপুর সিটির নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে ২৫ মে। আজ মঙ্গলবার রাত ১২টায় নির্বাচনী প্রচার শেষ হচ্ছে।
স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী জায়েদা খাতুন নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার আশঙ্কায় গত রোববার বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের কাছে চিঠি দিয়েছেন। নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং প্রচারণায় বাধার বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে গতকাল সোমবার চিঠি দিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান। নির্বাচন নিয়ে নিজেদের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলামও।
বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার বরাবর ইংরেজিতে দেওয়া তিন পাতার চিঠিতে জায়েদা খাতুন নির্বাচনে সেনা মোতায়েনসহ সাত দফা দাবি তুলে ধরেন। চিঠিতে তিনি কূটনীতিকদের মাধ্যমে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার জন্যও অনুরোধ জানান। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার বরাবর এই চিঠি দেওয়া হয়।
অবশ্য জায়েদা খাতুনের কূটনীতিকদের কাছে চিঠি দেওয়ার বিষয়টিকে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান। গতকাল সকালে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘উনি কেন অভিযোগ করলেন, জানি না। এটি সুষ্ঠু নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপতৎপরতা। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ইসি যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারে।’
কূটনীতিকদের দেওয়া চিঠিতে জায়েদা খাতুন অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা খান তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দিচ্ছেন। গণসংযোগে হামলা করছেন। সম্ভাব্য পোলিং এজেন্টদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। পুলিশ প্রশাসনও অযথা হয়রানি করছে। এসব বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি (জায়েদা খাতুন) অভিযোগ দিয়েছেন আর আমরা ব্যবস্থা নিইনি, এমন অভিযোগ সত্য নয়। তিনি একটিমাত্র অভিযোগ দিয়েছেন। সেই ঘটনায় থানায় মামলাও হয়েছে। কূটনীতিকদের কাছে অভিযোগ দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।’
গাজীপুর মহানগর পুলিশের কিছু সদস্য তাঁর নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি এবং ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পুলিশের কিছু সদস্যকে প্রভাবিত করতে প্রচুর কালোটাকা খরচ করছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন। নির্বাচন কমিশনের কাছে তাঁর নেতা-কর্মী বা এজেন্টদের বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করতে নির্দেশনার দাবি জানান তিনি।
এ অভিযোগের বিষয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, কাউকে হয়রানি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। হয়রানির কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে জানানো হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন আটজন। দলের মনোনয়ন না পেয়ে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তবে যাচাই-বাছাইয়ে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। এরপর তিনি মা জায়েদা খাতুনের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। জাহাঙ্গীরের মা জায়েদাকেই এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবা হচ্ছে।
বিএনপি ভোটে না থাকলেও দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের ভাতিজা সরকার শাহনুর ইসলাম এই নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। হাসান উদ্দিন সরকার গাজীপুর সিটির গত নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ছিলেন। বিএনপির ভোটারদের ভোট টানতে পারেন শাহনুর।
সরকার শাহনুর ইসলাম গতকাল বলেন, ‘প্রচার-প্রচারণায় নানাভাবে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। ভোট সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছি। ২০১৮ সালের ভোটের দিন বেলা ১১টার পরে কেন্দ্রে নৌকা বাদে অন্য কোনো প্রার্থীর এজেন্ট ছিল না। এবারও কর্মীরা এজেন্ট হতে ভয় পাচ্ছেন। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা নিরপেক্ষ থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।’
২০১৮ সালের নির্বাচনে তৃতীয় হয়েছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী। এবার দলটির প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান। গতকাল তিনি প্রশাসনের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক আচরণের অভিযোগে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে চিঠি দেন। তাতে তিনি বলেন, ইসলামী আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এমন অবস্থা থাকলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। হয়রানিমূলক আচরণের ছয়টি ঘটনা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
এ ব্যাপারে গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘প্রশাসন ও নৌকার কর্মীদের কারণে আমরা খুবই শঙ্কিত। এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন কোনোভাবেই আশা করতে পারি না।’
গতকাল গাজীপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। নির্বাচন-সংশ্লিষ্টদের আচরণ নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে সন্দেহ, সংশয় ও শঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার।
সুজনের গাজীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির বলেন, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে অধিকাংশ প্রার্থী শঙ্কায় আছেন। এর সম্ভাব্য কারণ বিগত নির্বাচনের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং এবারের নির্বাচনের আগে সরকারদলীয় প্রার্থীর প্রভাব। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কারণ, ইতিমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সরকারদলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে কমিশন ও প্রশাসনের ভিন্ন আচরণ করতে দেখা গেছে।