আদানির বিরুদ্ধে জালিয়াতির আরও অভিযোগ, বেরিয়েছে ‘শেয়ার জালিয়াতির’ নথি

0
114
গৌতম আদানি

ভারতের আলোচিত আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছিল মরিশাসের একটি তহবিল থেকে। সেই তহবিলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আদানি পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ী অংশীদারেরাই। গণমাধ্যমের করা নতুন এক তদন্তে এই অভিযোগ করা হয়েছে।

‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)’ আদানি গ্রুপের আর্থিক লেনদেন বিষয়ে এই তদন্ত করে। তাদের জোগাড় করা নথিপত্র ও অনুসন্ধানের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সংবাদ প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান ও বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

নথিতে দেখা গেছে, আদানি পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোকজন বছরের পর বছর ধরে গোপনে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার কিনেছেন। ঠিক সেই সময় উল্কার গতিতে আদানির উত্থান হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চও একই অভিযোগ তুলেছিল, যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছিল আদানি গোষ্ঠী। সেই প্রতিবেদনের জেরে অবশ্য গ্রুপটির বাজার মূলধন ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি কমে যায়। ব্যক্তিগত সম্পদ হারান গৌতম আদানিও।

হিনডেনবার্গের অভিযোগ ছিল, নিজেদের শেয়ার ঘুরপথে কিনে দাম বাড়াত আদানি গোষ্ঠী, অর্থাৎ শেয়ার জালিয়াতি করত। গৌতম আদানি ওই অভিযোগ নাকচ করে দিলেও এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়। এবার সেই তদন্ত চলাকালে সামনে এল ওসিসিআরপির এই চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন।

বিভিন্ন করসংক্রান্ত নথিপত্র ও আদানি গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ ই–মেইলের ভিত্তিতে এই অস্বচ্ছ লেনদেনের অভিযোগ তুলেছে ওসিসিআরপি। এটি একটি অলাভজনক মিডিয়া সংস্থা। তাদের অভিযোগ, অন্তত দুটি ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে অস্বচ্ছভাবে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার কেনাবেচা করা হয়েছে। এতে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম তরতর করে বেড়েছে। পরিণামে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে গৌতম আদানি বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনীর স্থানে উঠে আসেন। এরপর হিনডেনবার্গ ঝড়ে অবশ্য সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়।

গৌতম আদানি
গৌতম আদানি

এই অফশোর নেটওয়ার্কের ঠিকুজি-কুষ্ঠী এখন পর্যন্ত বের করা যায়নি। তবে এসব নথিতে জোরালো প্রমাণ আছে যে এসব অফশোর কর্মকাণ্ডে গৌতম আদানির ভাই বিনোদ আদানি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছেন। তবে এ বিষয়ে আদানি গোষ্ঠীর বক্তব্য ‘কোম্পানির দৈনন্দিন কার্যক্রমে বিনোদ আদানির কোনো ভূমিকা নেই’।

নথিতে দেখা যায় যে অফশোর কোম্পানি থেকে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেগুলো থেকে এককভাবে লাভবান হয়েছেন বিনোদ আদানির ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগী। এ ছাড়া বিভিন্ন আর্থিক রেকর্ড ও সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, মরিশাসভিত্তিক তহবিল থেকে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার কেনায় যে বিনিয়োগ করা হয়েছে, তা আবার দেখভাল করেছে দুবাইভিত্তিক এক কোম্পানি, যার পরিচালনায় আছেন বিনোদ আদানির একজন পরিচিত কর্মী।

দ্য গার্ডিয়ান মনে করছে, এসব ঘটনা উন্মোচিত হওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ, গৌতম আদানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ২০ বছরের পুরোনো।

এর আগে হিনডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরও নরেন্দ্র মোদি প্রশ্নের মুখে পড়েন। যেমন গৌতম আদানির সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক। এ ছাড়া আদানি গোষ্ঠীকে মোদি সরকার বিশেষ সুবিধা দেয় এমন অভিযোগও উঠেছে।

এদিকে ওসিসিআরপির প্রতিবেদনে উল্লেখিত অভিযোগের জবাব দিয়েছে আদানি গোষ্ঠী। তারা বলেছে, ওসিসিআরপির প্রতিবেদনে মরিশাসের যে তহবিলের কথা বলা হয়েছে, সেটা হিনডেনবার্গের প্রতিবেদনেও ছিল। এরপর হিনডেনবার্গের বেলায় তারা যা বলেছিল, এবারও তার পুনরুক্তি করেছে, পুরো অভিযোগই ভিত্তিহীন। আদানি গোষ্ঠীর দাবি, হিনডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট থেকেই তুলে এনে তা প্রকাশ করেছে ওসিসিআরপি। তাদের সব কোম্পানি আইন মেনে চলে।

যতকাণ্ড অফশোরে

যেসব নথিপত্র ওসিসিআরপির হাতে এসেছে, তাতে সেই ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন কোম্পানির জটিল এক বিস্তৃত জাল দেখা যায়। সেই সময় আদানি গোষ্ঠীর সহযোগী চ্যাং চু লিং ও নাসের আলি শাবান আহলি মরিশাস, ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া আইল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে শেল বা কাগুজে কোম্পানি গঠন শুরু করেন।

নথিপত্রে দেখা যায়, চ্যাং চু লিং ও নাসের আলি শাবান আহলি দুজনেই আদানির মালিকানাধীন কোম্পানির পরিচালক। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত চারটি অফশোর কোম্পানি বারমুডার বড় বিনিয়োগ তহবিল গ্লোবাল অপরচুনিটিস ফান্ডে (জিওএফ) বেশ কয়েক কোটি ডলার স্থানান্তর করে। ২০১৩ সালের পর থেকে এসব অর্থ ভারতের স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ হয়েছে।

অভিযোগে বলা হয়, এই অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে অস্বচ্ছতার সঙ্গে। আর্থিক লেনদেনের রেকর্ড থেকে জানা যায়, এই দুজনের মালিকানাধীন অফশোর কোম্পানি থেকে প্রথমে জিওএফ ও পরে সেখান থেকে আরও দুটি তহবিলে পাঠানো হয়। এ দুই তহবিল হলো ইমার্জিং ইন্ডিয়া ফোকাস ফান্ডস (ইআইএফএফ) ও ইএম রিসার্জেন্ট ফান্ড (ইএমআরএফ)।

এরপর আদানি গোষ্ঠীর চারটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে এসব তহবিল থেকে বিনিয়োগ করা হয়। এগুলো হলো—আদানি এন্টারপ্রাইজ, আদানি পোর্টস, স্পেশাল ইকোনমিক জোন ও আদানি পাওয়ার। পরবর্তীকালে আদানি ট্রান্সমিশনেও অর্থ বিনিয়োগ হয়। এরপর রেকর্ড থেকে উঠে আসে এসব অস্বচ্ছ তহবিল থেকে কীভাবে ভারতের মতো দেশে নিবন্ধিত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ হতে পারে।

আবার এসব বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে দুবাইভিত্তিক এক পরামর্শক কোম্পানির পরামর্শে, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল বিনোদ আদানির এক সহযোগীর হাতে, যিনি আবার এক সময় বিনোদের কর্মীও ছিলেন।

গৌতম আদানির সাম্রাজ্যে রীতিমতো ঝড় বইয়ে দিয়েছে হিনডেনবার্গ রিসার্চ
গৌতম আদানির সাম্রাজ্যে রীতিমতো ঝড় বইয়ে দিয়েছে হিনডেনবার্গ রিসার্চ, রয়টার্স

এরপর ২০১৪ সালের মে মাসে দেখা গেল, আদানি গোষ্ঠীর তিনটি কোম্পানিতে ইআইএফএফের বিনিয়োগ ১৯ কোটি ডলার। অন্যদিকে ইএমআরএফ নিজের পোর্টফোলিওর দুই-তৃতীয়াংশ বা সাত কোটি ডলার আদানি গোষ্ঠীর স্টকে বিনিয়োগ করেছে। উভয় তহবিলের অর্থ এসেছে চ্যাং চু লিং ও নাসের আলি শাবান আহলির নিয়ন্ত্রিত তহবিল থেকে।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে পৃথক আরেকটি আর্থিক রেকর্ড থেকে দেখা যায়, চ্যাং ও আহলির অফশোর কোম্পানি সেই কাঠামো ব্যবহার করে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে ২৬ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।

নথিপত্রে দেখা যায়, পরবর্তী কয়েক বছরে এসব বিনিয়োগ বেড়েছে। ২০১৭ সালের মার্চে দেখা যায়, চ্যাং ও আহলির মালিকানাধীন অফশোর কোম্পানির পোর্টফোলিওর শতভাগ বা ৪৩ কোটি ডলার আদানি গোষ্ঠীর স্টকে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে দ্য গার্ডিয়ান চ্যাংকে ফোন করলে এসব নথিপত্রে উল্লিখিত এসব বিনিয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এ ছাড়া বিনোদ আদানির সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়েও তিনি কথা বলেননি। অন্যদিকে বিনোদ ও আহলিও মন্তব্যের জন্য গার্ডিয়ানের আহ্বানে সাড়া দেননি।

সেবিও অভিযোগ তুলেছে

এদিকে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্তের গতিপ্রকৃতি জানিয়ে গত শুক্রবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দেশটির পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি। তদন্তে কী পাওয়া গেছে, তা না জানালেও প্রতিবেদনে নিজেদের গৃহীত প্রতিটি পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে তারা।

তবে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে, সেবিও আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কিছু অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। সম্পর্কিত বিভিন্ন সংস্থার (রিলেটেড পার্টি) সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের তথ্য না জানানো এবং বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে সেই প্রতিবেদনে। যদিও এসব নিয়ম লঙ্ঘন ‘টেকনিক্যাল’ বিষয় এবং সেই ভুলের সর্বোচ্চ শাস্তি আর্থিক জরিমানা, এর বেশি কিছু নয়।

এদিকে আদানি গোষ্ঠীর প্রতি সরকারের পক্ষপাতের অভিযোগ করেই যাচ্ছে ভারতের বিরোধী দলগুলো। গুজরাটে আদানি পাওয়ারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা নিয়ে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিল দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস, এরপর কংগ্রেসের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে আম আদমি পার্টি বা আপ।

সব মিলিয়ে আদানি গোষ্ঠী খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। যদিও হিনডেনবার্গের ধাক্কা সামলে উঠতে তারা বিভিন্নভাবে ব্যবসা সম্প্রসারণ শুরু করেছিল। এবার নতুন এই ধাক্কায় কী হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.