বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি লাগে। এখন সংশোধিত শ্রম আইনে কারখানার আকারভেদে ২০ থেকে ৪০০ জন শ্রমিকের সম্মতির কথা বলা হয়েছে। যেমন কোনো কারখানায় ২০ থেকে ৩০০ শ্রমিক থাকলে ২০ জন এবং ৩০১ থেকে ৫০০ শ্রমিক থাকলে ৪০ জনের সম্মতি লাগবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ নীতিগত ও চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
বিদ্যমান আইনটিকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার পাশাপাশি দেশের শ্রমমানকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, মালিক-শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা এবং শ্রমিকের কল্যাণ ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে নতুন আইনের সারসংক্ষেপে।
বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এ অধ্যাদেশ অনুমোদনের কথা সাংবাদিকদের জানান।
বিদ্যমান আইনটিকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার পাশাপাশি দেশের শ্রমমানকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা, মালিক-শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা এবং শ্রমিকের কল্যাণ ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে নতুন আইনের সারসংক্ষেপে।
অনুমোদিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন হবে এখন শ্রমিকের সংখ্যা ও কারখানার আকার অনুযায়ী। কারখানার আকার বড় হলে বেশি শ্রমিকের সম্মতি নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করতে হবে, আকার ছোট হলে শ্রমিকের সংখ্যাও লাগবে কম। অনুমোদন হওয়ার পর গতকালই তা আইন মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষার (ভেটিং) জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ভেটিং শেষে জারি হবে প্রজ্ঞাপন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গত রাতে বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় ধরে এটা নিয়ে কাজ হয়েছে। শ্রমিক, কারখানার মালিক ও সরকারের মোটামুটি সম্মতি নিয়েই এটা করা হয়েছে। তিন পক্ষকেই আমি ধন্যবাদ জানাই এবং আমি বিশ্বাস করি, এটা আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে করা হয়েছে।’
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, কারখানার আকার অনুযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০ থেকে ৩০০ জন শ্রমিক থাকা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ২০ জন, ৩০১ থেকে ৫০০ জন শ্রমিক থাকা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪০ জন, ৫০১ থেকে ১ হাজার ৫০০ জন শ্রমিক থাকা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১০০ জন, ১ হাজার ৫০১ থেকে তিন হাজার শ্রমিক থাকা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৩০০ জন এবং তিন হাজার ১ থেকে তার বেশি শ্রমিক থাকা প্রতিষ্ঠানে ৪০০ জন শ্রমিকের সম্মতি লাগবে ট্রেড ইউনিয়ন করতে গেলে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, একটি কারখানায় সর্বোচ্চ ট্রেড ইউনিয়ন হতে পারবে এখন পাঁচটি, বর্তমান নিয়ম তিনটি। ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা একাধিক হলে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন করা হবে যৌথ দর-কষাকষি প্রতিনিধিদল বা সিবিএ।
এক বছরের বেশি সময় ধরে এটা নিয়ে কাজ হয়েছে। শ্রমিক, কারখানার মালিক ও সরকারের মোটামুটি সম্মতি নিয়েই এটা করা হয়েছে। তিন পক্ষকেই আমি ধন্যবাদ জানাই এবং আমি বিশ্বাস করি, এটা আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে করা হয়েছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন
বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সর্বশেষ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে শ্রমিকের সংখ্যার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা মানা হয়নি। এর দায়দায়িত্ব এখন সরকারকেই নিতে হবে।
কত ছিল এ সংখ্যা—জানতে চাইলে বিকেএমইএ সভাপতি বলেন, ৩০০ জন শ্রমিক থাকা কারখানার ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন করতে ৫০ জন শ্রমিকের সম্মতির সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ৩০১ থেকে ১ হাজার জনের কারখানার ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল ১৫০ জনের সম্মতি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখন ছোট কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করা একটু কঠিন হয়ে যাবে। কোনো কারখানায় যদি ৩০ জন শ্রমিক থাকেন আর ২০ জন শ্রমিক মিলে যদি ইউনিয়ন করতে চান, তাহলে শতাংশ আকারে তা অনেক বেশি হয়ে যাবে, যা এত দিন ২০ শতাংশ ছিল।
শ্রমিকনেতা বাবুল আখতার বলেন, ‘ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শ্রমিকদের সংখ্যার যে শ্রেণি করা হয়েছে, তা সন্তোষজনক। যদিও আমরা আরেকটু কমসংখ্যক শ্রমিকের সম্মতিতে ইউনিয়ন নিবন্ধনের দাবি করেছিলাম। তারপরও যা করা হয়েছে, তাতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন সহজ হবে। তবে শ্রম দপ্তরের অনিয়ম দূর না হলে এর সুফল মিলবে না।’ তিনি বলেন, শ্রমিকের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা ও গৃহপরিচারককে শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করা ইতিবাচক।
শ্রম আইনে গৃহপরিচারকদের যুক্ত করা হয়েছে। গৃহপরিচারক বলতে এমন কোনো ব্যক্তিকে বোঝাবে, যিনি নিয়োগকারীর বাসায় মৌখিক বা লিখিতভাবে খণ্ড বা পূর্ণকালীন নিয়োগের মাধ্যমে গৃহকাজ করেন। এ ক্ষেত্রে মেস বা ডরমিটরিও গৃহ হিসেবে বিবেচিত হবে।
শ্রমিককে কালোতালিকাভুক্ত করা যাবে না
মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হন শ্রমিকেরা। আন্দোলন ঠেকাতে শিল্পমালিকেরা অনেক সময় শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করার পাশাপাশি তাঁদের কালোতালিকাভুক্ত করেন। তখন শ্রমিকদের নতুন কারখানায় চাকরি পাওয়া কঠিন হয়। সংশোধিত শ্রম আইন অধ্যাদেশে শ্রমিকদের কালোতালিকাভুক্ত নিষেধ করা হয়েছে।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক বা মালিকদের কোনো সংগঠন কর্মরত কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই, বরখাস্ত, অপসারণ, অবসর বা অন্য কোনো কারণে চাকরি থেকে অবসানের পর নতুন কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করার উদ্দেশ্যে কালোতালিকাভুক্ত করা যাবে না।
গৃহপরিচারকেরাও শ্রমিক
শ্রম আইনে গৃহপরিচারকদের যুক্ত করা হয়েছে। গৃহপরিচারক বলতে এমন কোনো ব্যক্তিকে বোঝাবে, যিনি নিয়োগকারীর বাসায় মৌখিক বা লিখিতভাবে খণ্ড বা পূর্ণকালীন নিয়োগের মাধ্যমে গৃহকাজ করেন। এ ক্ষেত্রে মেস বা ডরমিটরিও গৃহ হিসেবে বিবেচিত হবে। কোনো ব্যক্তিকে জোরপূর্বক বা বাধ্যতামূলক কোনো কাজ করানো যাবে না। কেউ এ ব্যাপারে কাউকে সহায়তাও করতে পারবে না।
এ ছাড়া শ্রমিকের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, শ্রমিক অর্থ শিক্ষানবিশসহ কোনো ব্যক্তি, চাকরির শর্ত প্রকাশ্যে বা ঊহ্য যেভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোনো প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোনো ঠিকাদার, যে নামেই অভিহিত হোক না কেন, তাঁর মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে কোনো দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা উন্নয়নমূলক বা করণিক কাজে নিযুক্ত কর্মচারী বা কর্মকর্তা যে নামেই হোক না কেন, তাঁরা অন্তর্ভুক্ত হবেন।
১০০ স্থায়ী শ্রমিক থাকলে ভবিষ্য তহবিল
বর্তমান আইনে শ্রমিকদের সুবিধার জন্য ভবিষ্য তহবিল গঠনের কথা বলা থাকলেও তা বাধ্যতামূলক নয়। অধ্যাদেশে তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ১০০ স্থায়ী শ্রমিক থাকলেই মালিকপক্ষ তাদের জন্য ভবিষ্য তহবিল গঠন করতে বাধ্য থাকবে।
তবে বিকল্প ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবে। তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে ‘প্রগতি স্কিম’, যাতে মালিক ৫০ শতাংশ ও শ্রমিক ৫০ শতাংশ চাঁদা দেবেন। তবে কোনো সদস্য স্কিমে থাকতে না চাইলে লিখিতভাবে মালিকপক্ষকে জানাতে হবে।
প্রসূতি ছুটি ৮ দিন বাড়ল
প্রত্যেক নারী কর্মী প্রতিষ্ঠানের কাছে সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখের আগের ৬০ দিন এবং সন্তান প্রসবের পরের ৬০ দিনের জন্য ছুটি নিতে পারবেন। কর্তৃপক্ষ এ ছুটি দিতে বাধ্য থাকবে। বর্তমানে প্রসূতি ছুটি ১১২ দিন। এখন ৮ দিন বাড়িয়ে ১২০ দিন করা হলো।
গার্মেন্ট শ্রমিক সংগতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, ‘আমরা শ্রমিকের অধিকার ও জীবনমান উন্নত করতে শ্রম আইনে বিভিন্ন সংশোধন চেয়েছিলাম। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানতে পেরেছি, ইতিবাচক বলেই মনে হচ্ছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি ১৮০ দিন করার দাবি করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত ১২০ দিন করা হয়েছে। এটিকে এক ধাপ উত্তরণ বলা যায়।’
কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ তহবিল
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, আইনের অন্যান্য বিধানে যা–ই থাকুক না কেন, সরকার বিধির মাধ্যমে কর্মস্থলে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ তহবিল প্রতিষ্ঠা করবে। তহবিলের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের গঠন, তাদের কাজ, সুবিধার মাত্রা, তহবিলের অর্থায়ন উৎস ও পদ্ধতি ইত্যাদি বলা হবে বিধিতে। এটি একটি নতুন ধারা। প্রজ্ঞাপনে বলা হবে কোন কোন শিল্প বা খাতে এ তহবিল প্রযোজ্য হবে।
উপদেষ্টা পরিষদকে জানানো হয়েছে, বর্তমানে পোশাক খাতে ক্ষতিপূরণ তহবিলের পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চলমান রয়েছে, যেখানে ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা অবদান রাখছেন।
শ্রমসংক্রান্ত ব্যক্তিগত ও যৌথ বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য অধ্যাদেশে একটি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কর্তৃপক্ষ গঠনের কথাও বলা হয়েছে। এটি পরিচালিত হবে নিরপেক্ষ ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে। শ্রম আদালতে পুঞ্জীভূত মামলার জট কমাতে এটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পর্যবেক্ষণ ছিল। তবে বিষয়টি নিয়ে পরে বিধি প্রণয়ন করবে সরকার।
















