আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বৈঠক নির্বাচনী পরিবেশ রক্ষায় কঠোর হতে ইসির নির্দেশ

0
18
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন–পূর্ব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক। রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে, ছবি: ইউএনবি

নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করে, এমন কর্মকাণ্ড ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সাংবিধানিক এই সংস্থা বলেছে, যারা নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করতে চায়, তাদের প্রতি মানবিক হওয়ার দরকার নেই। সাম্প্রতিক সময়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে মাঠপর্যায়ে যৌথ বাহিনীকে অভিযান জোরদার করতে নির্দেশনা দিয়েছে ইসি।

১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করে ইসি। এর পরদিনই ঢাকা ৮–এর সম্ভাব্য প্রার্থী, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে রাজধানীর পুরানা পল্টনে গুলি করা হয়। এ ঘটনার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে নানা সংশয় ও শঙ্কা দেখা দেয়। ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যু হয়। হাদির মৃত্যুর খবরে ওই রাতেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ রাস্তায় নেমে ক্ষোভ প্রকাশ করে। পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলা হয় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে। এসব ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ আরও বাড়তে থাকে।

এমন পরিস্থিতিতে গতকাল রোববার দুপুরে তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে ইসি। এরপর বিকেলে নির্বাচন–পূর্ব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীনের সভাপতিত্বে বৈঠকে অন্য চার নির্বাচন কমিশনার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, তিন বাহিনীর প্রধানদের প্রতিনিধি, পুলিশ, বিজিবি, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বৈঠকের সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন।

তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক

গতকাল দুপুর ১২টার দিকে নির্বাচন ভবনে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খানের সঙ্গে বৈঠক করে ইসি।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোটকে সামনে রেখে নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করতে রোববার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আসেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোটকে সামনে রেখে নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করতে রোববার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আসেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, ছবি: বাসস

নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, তিন বাহিনীর প্রধানেরা জানিয়েছেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা প্রস্তুতি প্রয়োজন, তা তাঁরা নিয়েছেন। নির্বাচনে সেনাবাহিনী এক লাখ সদস্য মোতায়েন করবে। এর এক–তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যে মাঠে আছে। বাকিরা নির্বাচনের আগেই মোতায়েন হয়ে যাবেন। তিনি জানান, এই বৈঠকে ইসি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাসীদের আটকের ওপর জোর দিয়েছে। বাহিনীগুলো ইসিকে আশ্বস্ত করেছে যে তারা একটি ভালো নির্বাচন করার জন্য বদ্ধপরিকর।

পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও নির্দেশনা

বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধে যৌথ বাহিনীর কার্যক্রম এবং আচরণবিধিমালা প্রতিপালন নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়।

আলোচনার বিষয় তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করে, এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড সহ্য করা হবে না। নির্বাচনের পরিবেশ ক্ষতি করে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড নিরুৎসাহিত করতে বাহিনীগুলোকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড প্রয়োজনে বাধা দিতে যা করা প্রয়োজন, তা তারা করবে।

এই নির্বাচন কমিশনার জানান, মাঠপর্যায়ে যৌথ বাহিনীর অভিযান চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর অন্যতম লক্ষ্য হবে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার এবং সার্বিকভাবে সাধারণ মানুষ ও প্রার্থীদের মাঝে একটা আস্থার পরিবেশ তৈরি করা। ইসি এলাকাভিত্তিক চেকপয়েন্ট বসানোর ওপরও গুরুত্ব দিয়েছে। দল ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ইতিমধ্যে প্রটোকল দাঁড় করিয়েছে, সে অনুযায়ী যাঁরা চাইছেন, তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, সম্প্রতি বেশ কিছু জায়গায় নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে। সেগুলো নিয়ে ইসি বাহিনীগুলোর কাছে জানতে চেয়েছে। প্রাথমিকভাবে বাহিনীগুলোর মূল্যায়ন ইসিকে জানানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এসব কর্মকাণ্ডে মূলধারার কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পৃক্ততা এখনো পাওয়া যায়নি। তারা সবাই এই কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করে। যারা এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত, তারা যে-ই হোক, যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে ইসির পক্ষ থেকে কঠোরভাবে বলা হয়েছে।

গণমাধ্যমে হামলায় ইসির উদ্বেগ

একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, তফসিল ঘোষণার পর দুটি প্রথম সারির গণমাধ্যমের (প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার) কার্যালয়ে যে সহিংস হামলার ঘটনা ঘটেছে, তাতে সাংবাদিকেরা নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করছেন। বৈঠকে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, জানতে চাওয়া হয়।

আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত সভার পর নির্বাচন ভবনে প্রেস ব্রিফিংয়ে ইসি। রোববার নির্বাচন ভবনে
আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত সভার পর নির্বাচন ভবনে প্রেস ব্রিফিংয়ে ইসি। রোববার নির্বাচন ভবনে

জবাবে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, এ বিষয়গুলো ইসিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জানতে চেয়েছে। ইসিও এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন। কারণ, তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলাজনিত ঘটনা ঘটলেও সেটার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব নির্বাচনের ওপর পড়ে।

সাংবাদিকদের এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘আপনারা আমাদের অংশীজন এবং পার্টনার। আপনারা নিরাপদ বোধ না করলে দায়িত্ব পালন করবেন কীভাবে? আমরা যেটা অবহিত হয়েছি, একটা জাতীয় শোকের সময় যখন সবাই শোকে মুহ্যমান, তখন ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী কিছু লোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ওভারপাওয়ার করে এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। এই সুযোগ আর দেওয়া হবে না, মেসেজ ইজ ভেরি ক্লিয়ার।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনার পর থেকে সব বাহিনীর প্রতি মানবিক হওয়ার এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার নির্দেশনা ছিল। তাঁরা মনে করছেন, কেউ কেউ এই ভালো উদ্যোগের সুযোগ নিয়েছেন। ইসি কঠোরভাবে বলেছে, ‘যারা মানবিক, তাদের প্রতি আমরা মানবিক হব, কিন্তু যারা “ভ্যান্ডালিজম” করতে চায় বা নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করতে চায়, আমার ভাইকে হত্যা করতে চায়, তাদের প্রতি মানবিক হওয়ার দরকার নেই।’

ব্রিফিংয়ে একজন সাংবাদিক বলেন, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছেন ডেইলি স্টার–এ হামলার সময় বিশৃঙ্খলাকারীরা সেনাবাহিনীকে ২০ মিনিট সময় দিচ্ছে। এ ঘটনাকে ইসি কীভাবে দেখছে।

জবাবে আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, সেখানে ‘মিনিট বাই মিনিট’ কী ঘটেছে তা নিয়ে তিনি অবগত নন। তবে এটি একটি ‘ভ্যান্ডালিজম’ এবং নির্বাচনী পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলছে। একটি বৃহত্তর আবেগ কাজে লাগিয়ে দুষ্টচক্র যে কাজটি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে অন্তত ২০ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

সার্বিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে

এক প্রশ্নের জবাবে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, মাঠপর্যায়ে নির্বাচনী কার্যক্রম চলমান আছে এবং অন্যান্য জায়গায় নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলো আচরণবিধি প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অতীতের চেয়ে বেশি সতর্ক। সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। যারা নির্বাচন বিঘ্নিত করতে চায়, তাদের টার্গেট মূলত শহর এলাকা।

এক প্রশ্নের জবাবে আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, শহীদ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের শোককে শক্তিতে পরিণত করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। যারা উৎসবের পরিবেশ বিঘ্নিত করতে চায় তারা ব্যর্থ হবে এবং উৎসবের পরিবেশ ফেরত আসবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.