বাংলাদেশে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদ। গত সোমবার রাতে সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদের বৈঠকে এ ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ঋণের প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। প্রথম কিস্তির অর্থ ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশ পাবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র সমকালকে জানিয়েছে।
ঋণ অনুমোদনের পর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএমএফ জানিয়েছে, এক্সটেনডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) বা বর্ধিত ঋণ সুবিধা ও এক্সটেনডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএএফএফ) বা বর্ধিত তহবিল সুবিধার আওতায় ৩৩০ কোটি মার্কিন ডলার এবং নতুন গঠিত তহবিল রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় ১৪০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রথম কিস্তির জন্য ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ছাড়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ৪২ মাসের মধ্যে পুরো অর্থ ছাড় হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, আইএমএফের নিজস্ব মুদ্রা স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস বা এসডিআরে সংস্থাটি এ ঋণ দেবে। গত জুলাইতে ঋণের আলোচনা শুরুর সময় ডলার ও এসডিআরের মধ্যে বিনিময় হারের ভিত্তিতে তখন ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া যাবে বলে ধরা হয়। কিন্তু বর্তমানে এসডিআরের তুলনায় ডলারের মূল্য কিছুটা কমে যাওয়ায় ঋণের পরিমাণ ৪৭০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে।
তবে আগামীতে যদি বিনিময় হারে আরও পরিবর্তন আসে তাহলে ডলারের হিসাবে কমতে বা বাড়তে পারে। মোট ঋণের আকার ৩৫০ কোটি এসডিআর।
আইএমএফের ঋণ পেতে বেশ কিছু শর্ত পালন করতে হবে। ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের দেওয়া কোন কোন শর্ত পালনে সম্মত বাংলাদেশ, তার জন্য মেমোরেন্ডাম অব ইকোনমিক ফিন্যান্সিয়াল পলিসি (এমওইএফপি) গ্রহণ করা হয়েছে। এটি আইএমএফ প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি চূড়ান্ত করে প্রথম কিস্তি ছাড়ের আগেই প্রকাশ করবে সংস্থাটি।
এ ছাড়াও কিছু দাপ্তরিক কার্যক্রম রয়েছে। ঋণের প্রথম কিস্তি আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাওয়া যাবে বলে আইএমএফ থেকে জানানো হয়েছে। এরপর প্রতিটি কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখবে আইএমএফ।
আইএমএফের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কভিড মহামারির ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। ডলারের বিপরীতে দ্রুত মান হারিয়েছে টাকা। দেশের চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়েছে। অর্থনীতির এসব সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ মনে করে, তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোগত ইস্যু এবং জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানো, বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এসব জরুরি।
আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ বলেন, এ ঋণ বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়তা করবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যেসব সংস্কার হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নেও সহায়তা করবে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে আরও টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সরকারকে তার উচ্চাভিলাষী সংস্কার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে মানবসম্পদ ও অবকাঠামো খাতে আরও বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনেও তা জরুরি। বাংলাদেশ সরকার এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও বাংলাদেশ অবগত।
অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ বলেন, রাজস্ব খাতে সংস্কার করলে বাংলাদেশে সামাজিক খাত, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় বাড়াতে হবে। তবে সে জন্য করনীতি ও রাজস্ব প্রশাসন উভয় খাতের সংস্কারেই হাত দিতে হবে। রাজস্ব সংস্কার হলে সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এতে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং শাসন ব্যবস্থা উন্নত হবে।
আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমলে, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করা হলে এবং পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ঘটলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা সম্ভব হবে। প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়াতে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। সে জন্য দরকার বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর সহায়ক পরিবেশ তৈরি, মানবসম্পদ ও শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন।