
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে গত মঙ্গলবার ছিনতাই হওয়া ট্রেনের বেঁচে ফেরা যাত্রীরা সেদিনের ঘটনার মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছেন। এই যাত্রীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে, কীভাবে চোখের সামনে তাঁদের সহযাত্রীদের হত্যা করা হচ্ছিল, আর গুলির বৃষ্টি চলার মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে অন্যরা ছোটাছুটি করছিলেন, সেসব দৃশ্য।
বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) কয়েক ডজন যোদ্ধা ওই দিন যাত্রীবাহী জাফর এক্সপ্রেসের নয়টি বগি নিশানা করেন। পার্বত্য এলাকা বোলান পাসের ঔপনিবেশিক আমলের পাথুরে সুড়ঙ্গ অতিক্রমকালে রকেটচালিত গ্রেনেড ও মুহুর্মুহু গুলি ছুড়ে ট্রেনে হামলা চালান এবং সব যাত্রীকে জিম্মি করেন তাঁরা।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী কোয়েটা থেকে সকাল ৯টায় উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ খাইবার পাখতুনখাওয়ার রাজধানী পেশোয়ারের উদ্দেশে ছেড়ে আসে ট্রেনটি। পথিমধ্যে বেলা ১টার দিকে কোয়েটা থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে সিবি শহরের কাছে এটি ছিনতাইয়ের শিকার হয়।
জাফর এক্সপ্রেসকে শেষ গন্তব্য পেশোয়ারে যেতে পাঞ্জাব হয়ে ৩০ ঘণ্টায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল। যাত্রাপথে স্টেশন ছিল প্রায় ৩০টি।
ছিনতাই হওয়ার সময় ট্রেনে ৪০০-এর মতো যাত্রী ছিলেন। এ ঘটনার দায় স্বীকার করে বিএলএ মঙ্গলবার বলেছিল, তারা পাকিস্তান সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার সময় দিচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে বেলুচ রাজবন্দী, জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তি ও জাতীয় প্রতিরোধ কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
গত বুধবার রাতে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, ট্রেনটিতে তাদের অভিযান শেষ হয়েছে। ৩৪৬ যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। ৩৩ হামলাকারী সবাই নিহত হওয়া ছাড়াও প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ যাত্রী, ট্রেনচালক ও আধা সামরিক বাহিনীর ১ জন সদস্য।
ছিনতাই হওয়ার সময় ট্রেনে ৪০০–এর মতো যাত্রী ছিলেন। এ ঘটনার দায় স্বীকার করে বিএলএ মঙ্গলবার বলেছিল, তারা পাকিস্তান সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার সময় দিচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে বেলুচ রাজবন্দী, জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তি ও জাতীয় প্রতিরোধ কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
‘তারা যাত্রীদের এক পাশে নিয়ে যায় ও গুলি করতে থাকে’
নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে মুক্তি পাওয়া যাত্রীরা কয়েক ঘণ্টার জিম্মিদশায় যে ভয়ানক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন, তার বর্ণনা দেন।
বেঁচে ফেরা ট্রেনের আরোহীদের একজন গুলাম সারওয়ার (৪৮)। তিনি ট্রেনের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আল–জাজিরাকে তিনি বলছিলেন, ‘আমি চোখের সামনে অনেককে মরতে দেখছিলাম। ভাবছিলাম, এরপর আমার পালা। কিন্তু বুধবার সকালে (ট্রেন ছিনতাই হওয়ার পরদিন) আমি অন্য যাত্রী ও সহকর্মীদের সঙ্গে পালাতে সক্ষম হই।’
ট্রেনে ছিলেন পাকিস্তান রেলওয়ে পুলিশের একজন সহকারী উপপরিদর্শকও। একসময় তিনিও একদল যাত্রী ও সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে দুঃসাহসিকভাবে বেঁচে ফিরতে সমর্থ হন।

চার সশস্ত্র রেলকর্মী ও পাঁচ সেনাসদস্যের সঙ্গে কোয়েটা থেকে ট্রেনটিতে উঠেছিলেন সারওয়ার। এই রেলকর্মী ও সেনারা নিয়মমাফিক যাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন। সারওয়ার বলছিলেন, যখন হামলা শুরু হয়, তখন তিনি ও অন্য সশস্ত্র কর্মীরা পাল্টা গুলি চালানো শুরু করেন।
গুলাম সারওয়ার বলছিলেন, ‘মনে হচ্ছিল, ট্রেন লক্ষ্য করে রকেট ও গুলি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরাও পাল্টা গুলি করে জবাব দিচ্ছিলাম। যখন আমাদের গুলি ফুরিয়ে গেল, তখন তাঁরা ট্রেনের দিকে আসেন এবং যাত্রীদের বের করে নেওয়ার কাজ শুরু করেন।’
আমি চোখের সামনে অনেককে মরতে দেখছিলাম। ভাবছিলাম, এরপর আমার পালা। কিন্তু বুধবার সকালে (ট্রেন ছিনতাই হওয়ার পরদিন) আমি অন্য যাত্রী ও সহকর্মীদের সঙ্গে পালাতে সক্ষম হই।
গুলাম সারওয়ার, বেঁচে ফেরা যাত্রী
সারওয়ার বলেন, হামলাকারীরা যাত্রীদের পরিচয়পত্র যাচাই–বাছাই করে তাঁদের আলাদা করতে শুরু করেন। তাঁরা পাঞ্জাবি যাত্রী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অংশ বলে যাঁদের সন্দেহ করছিলেন, তাঁদের ধরে নিয়ে হত্যা করছিলেন।
এই নিরাপত্তা সদস্য বলেন, সশস্ত্র ব্যক্তিরা অনেক যাত্রীকে হত্যা করেছেন। কতজনকে হত্যা করেছেন, তা তিনি গুনতে পারেননি। তবে তিনি দেখেছেন, সশস্ত্র ব্যক্তিরা যাত্রীদের কয়েকটি গ্রুপকে রেললাইন থেকে নিয়ে যাচ্ছেন আর তাঁদের গুলি করছেন।
সারওয়ার বলেন, হামলাকারীরা সকাল ১০টা পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে গেছেন। পরে তাঁদের একটি বড় অংশ সেখান থেকে চলে যায়। আরেকটি অংশ সেখানে রয়ে গেছে। কেউ সেখান থেকে পালাতে চাইলেই তাঁরা গুলি করে হত্যা করেন।
সারওয়ার ও যাত্রীদের আরেকটি দল এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সারওয়ার বলেন, ‘আমরা পালিয়ে যাওয়ার সময় কাছের উপত্যকা থেকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করছিলেন। রেলের একজন পুলিশ সদস্য পেছন থেকে গুলিবিদ্ধ হন। তিনি সেখানেই নিহত হন।’
সারওয়ার বলেন, তিনি ও তাঁর সঙ্গী যাত্রীরা রেললাইন ধরে দৌড়াচ্ছিলেন। পেছন থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা গুলি করছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার দৌড়ে তাঁরা পনির রেলস্টেশনে পৌঁছাতে সক্ষম হন। সেখানে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের রিসিভ করেন।
ইঞ্জিনে আঘাত করল রকেট
মুরাদ আলী (৬৮) স্ত্রীকে নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলয়ী জাকোবাবাদে যাচ্ছিলেন। হামলাকারীরা তাঁকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। তিনিও ট্রেনকে লক্ষ্য করে বিএলএর সশস্ত্র ব্যক্তিদের হামলার দৃশ্য দেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাপক গুলিবর্ষণের শব্দ শোনার পর আমি দেখলাম, একটি রকেট ট্রেনের ইঞ্জিনে আঘাত করেছে। তাঁরা আমাদের বগির ভেতরে ঢুকে পড়েন এবং আমার জাতিগত পরিচয় জানতে চান। আমি যখন নিজেকে সিন্ধি বলে পরিচয় দিই, তখন তাঁরা আমাকে ছেড়ে দেন।’
মুরাদ আলী বলেন, ‘আমি কয়েক ডজন নারী ও শিশুর সঙ্গে বের হলাম। আমরা রেললাইন ধরে পনির রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ পথ হেঁটে যাই। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। সেখান থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের মাচ রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যায়।’ মুরাদ দম্পতি পরে সেখান থেকে কোয়েটা ফিরে যান।
মুরাদের স্ত্রী বিবি ফারজানা তখনকার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘গুলি ও বিস্ফোরণের কারণে পুরো ট্রেন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল।’ তিনি বলেন, অস্ত্রধারীরা সব যাত্রীকে ট্রেন থেকে বাইরে বের করে আনেন। সেখান থেকে তাঁরা অন্যান্য যাত্রীর মধ্য থেকে পাঞ্জাবিদের আলাদা করেন।
গতকাল বুধবার পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেন, তাঁদের বাহিনী যাত্রীদের উদ্ধার অভিযান চালাতে গিয়ে ৩০ জন অস্ত্রধারীকে হত্যা করেছেন। তখনো অভিযান চলছিল। অবশ্য পরে গতকাল রাতেই অভিযান শেষ করে নিরাপত্তা বাহিনী।
বেলুচিস্তান প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সরফরাজ বুগতি বলেন, বিচ্ছিন্নতবাদীরা এই হামলা চালিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় যে কোয়েটা হচ্ছে ‘সহিংস এলাকা’।
সরকার বলেছে, কোয়েটা রেলওয়ে স্টেশনে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। কোয়েটা স্টেশন থেকে পর্যাপ্ত কফিন নিয়ে রিলিফ হামলাস্থলে পাঠানো হয়েছে।
বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করা বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা অভিযোগ করে আসছেন, স্বাধীনতার পক্ষে যাঁরাই কথা বলেন, সরকার তাদের অপহরণ ও তাঁদের ওপর নির্যাতন–নিপীড়ন চালাচ্ছে।
দুই বছর ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ট্রেনে হামলা চালিয়ে আসছে। তবে এবারই প্রথম তারা ট্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করল।
আল জাজিরা
কোয়েটা