অলস পড়ে নষ্ট হচ্ছে ২৮৩ কোটি টাকার চিকিৎসাযন্ত্র

0
15

চিকিৎসায় বিদেশমুখিতা কমানো ও দেশেই প্রযুক্তিনির্ভর অত্যাধুনিক সেবা নিশ্চিত করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করে তৈরি করা হয়েছে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। তবে ১ বছর ৯ মাস পার হলেও হাসপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু করা যায়নি। জনবল সংকটে রোগ নির্ণয়ে কেনা ২৮৩ কোটি টাকায় আধুনিক চিকিৎসাযন্ত্র অলস পড়ে আছে। মৌলিক পরীক্ষায় হাতেগোনা কয়েকটি যন্ত্র কালেভদ্রে ব্যবহার হলেও আদতে স্বল্পমূল্যের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন জরুরি চিকিৎসাযন্ত্র এভাবে পড়ে থাকলে ব্যবহারের আগেই নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, ভুল ব্যবস্থাপনা, জনবল নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে চাহিদার ৮৬ শতাংশ কম জনবল দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়নে গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বিশেষায়িত এ হাসপাতাল। নিয়োগ জটিলতা না কাটলে পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু সম্ভব নয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিএসএমএমইউ সূত্র জানিয়েছে, অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ খরচ হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪০৩ রকমের ৬ হাজার ৬১২টি চিকিৎসাযন্ত্র কেনা হয় ৩৩ মিলিয়ন ডলারে। সে সময় ১ ডলারের মূল্য ছিল ৮৬ টাকা। সে হিসাবে এ যন্ত্র কিনতে টাকা লেগেছিল ২৮৩ কোটি। এসব যন্ত্রপাতি ২০২২ সালের আগস্ট ও ডিসেম্বরে দুই ধাপে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করে দক্ষিণ কোরিয়ান বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান স্যামসাং। যন্ত্রগুলো সেবার উপযোগী থাকলেও জনবল না থাকায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি এক দিনও ব্যবহার হয়নি। এসব যন্ত্রের সর্বোচ্চ মেয়াদ রয়েছে তিন বছর। ফলে ব্যবহারের আগেই শেষ মেয়াদের প্রায় দুই বছর। আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জনবল সংকটের সমাধান না হলে যন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণে নতুন করে টাকা খরচ করতে হবে সরকারকে।

এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্য এমনিতেই কম বরাদ্দ পায়। এ বরাদ্দের যথাযথ ব্যবহার হয় না। বিশেষ করে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে দুর্নীতির কারণে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের ২৮৩ কোটি টাকার যন্ত্রে মানুষের সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া বিচারহীনতার সংস্কৃতি লক্ষ্য করা গেছে। এ হাসপাতালে চিকিৎসক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। যন্ত্র ক্রয়ে দুর্নীতি হয়েছে কিনা, তা দেখা উচিত। আশা করি, বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী এসব দুর্নীতির বাইরের লোক। তিনি এ যন্ত্র সচলে ব্যবস্থা নেবেন।

গত শনিবার দুপুরে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ১০০ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তালা ঝুলছে।
এ ছাড়া ১০০ শয্যার জরুরি ইউনিট, ছয়টি ভিভিআইপি, ২২টি ভিআইপি ও ২৫টি ডিলাক্স কেবিনের কোনোটিই ব্যবহার হচ্ছে না। উদ্বোধনের পর কিছুদিন বেশ কিছু অস্ত্রোপচার হলেও এখন তাও বন্ধ।

হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গত সপ্তাহে এ হাসপাতালে ভর্তি হন পুরান ঢাকার মহসিন আলী। তাঁকে সিবিসি, ব্লাড কালচার ও ইউরিন কালচার পরীক্ষা দেওয়া হয়। তবে এ পরীক্ষার দুটিই করতে হয়েছে পাশের হাসপাতালে। মহসিন বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা মেলেনি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বদলে পরামর্শ দিচ্ছেন মেডিকেল অফিসার। এ হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্র থাকার পরও কেন বাইরে থেকে পরীক্ষা করতে হবে? কেন দ্বিগুণ টাকা রোগীকে গুনতে হবে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আতিক হাসান তিন বছর ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত। কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি নেওয়ার জন্য গত এপ্রিল থেকে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হয় এ হাসপাতালে। তবে পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু না হওয়ায় অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। পরে তিনি ভারতের এক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৭৫০ শয্যার এ হাসপাতালে বর্তমানে ৩৯ রোগী ভর্তি আছে। দৈনিক সর্বোচ্চ ১০০টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে ৫০০ জনের সেবা দেওয়ার লক্ষ্য থাকলেও এখন সেবা পান মাত্র ১২৫ রোগী। হাসপাতালে পড়ে থাকা যন্ত্র সচল রাখতে এক্সক্লুসিভ হেলথ চেকআপ চালু হয় গত জানুয়ারিতে। তবে ছয় মাসে এ সেবা নিয়েছেন মাত্র ৫৮ রোগী।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু আছে কিনা, তা শনাক্তসহ ২৬টি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আরটিপিসিআর মেশিন কেনা হয়। সম্প্রতি এ মেশিনে ব্যবহার করা হয় চায়না কিট। এর ফলে মেশিনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। যন্ত্রটি চালু করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ কোরিয়া সরকারকে চিঠি দেয়। দুই সপ্তাহ আগে কোরিয়ার সরকার যন্ত্রটি মেরামতে একটি প্রকৌশলী দল পাঠায়। প্রকৌশলী দলের এক সদস্য সমকালকে বলেন, এ মেশিন এক বছর পরপর সার্ভিসিং করতে হয়। তবে দুই বছরে একবারও সার্ভিসিং করা হয়নি। এ ছাড়া কোরিয়ার যন্ত্রে চায়না কিট ব্যবহার করা হয়েছে। এমন করলে যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে যাবে।

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের ল্যাব ইনচার্জ হারুন অর রশিদ বলেন, আরটিপিসিআর মেশিনটি সচল রাখতে পরীক্ষামূলকভাবে চায়না কিট ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া এসব যন্ত্র দীর্ঘদিন পড়ে থাকলে নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়। জনবল নিয়োগে বারবার চিঠি দিলেও কোনো অগ্রগতি নেই।

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের ল্যাবের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন বিএসএমএমইউর বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মোহাম্মদ মাসুম আলম। তিনি সমকালকে বলেন, কোরিয়ার মেশিনে চায়না কিট ব্যবহারের বিষয়টি আমার জানা নেই।

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমন আচার-আচরণে ক্ষুব্ধ দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার। দ্রুত জটিলতা কাটিয়ে সেবা চালু করার অনুরোধ করে দেশটির সরকার চিঠিও দিয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এটির মতো আরও একটি হাসপাতাল তৈরি করে দিতে চায় কোরিয়া। তবে এ হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু না করে ওই হাসপাতালের কাজ শুরু করা সম্ভব নয়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি পরিচালনার জন্য চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রয়োজন অন্তত ২ হাজার ৭০০ জন। এখন জনবল আছে ৩৮৪। সব শেষ নিয়োগে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও বিতর্কের কারণে জটিলতা তৈরি হয়েছে। যে কারণে ৮৬ শতাংশ কম জনবল দিয়ে চলছে এ হাসপাতাল। এখন পর্যন্ত পাঁচ দফায় ১৬০ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর মধ্যে হাসপাতালে যুক্ত হয়েছেন মাত্র ৩২ জন। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে প্রশিক্ষণই বন্ধ করে দিয়েছে কোরিয়া।

ব্যক্তিস্বার্থে বিশ্বমানের হাসপাতালকে ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ। নিয়মনীতি ছাড়াই সাবেক এ উপাচার্য অ্যাডহক ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে ডা. শারফুদ্দিনকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি।

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের সাবেক প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক মো. জুলফিকার রহমান খান বলেন, প্রায় ছয় হাজার যন্ত্র বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এ যন্ত্র চালানোর মতো দক্ষ জনবল নেই। এসব যন্ত্র দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণ না করায় যে কোনো সময় এগুলো বিকল হয়ে যেতে পারে।

এ প্রকল্পের শুরু থেকে যুক্ত ছিলেন বিএসএমএমইউর আরেক প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান। তিনি বলেন, এসব যন্ত্র ব্যবহার না হওয়ায় বেশি ভুগছে দরিদ্র রোগী। বেসরকারি হাসপাতালে বেশি টাকা খরচ করে  চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। কোরিয়ার সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সেবা চালু করার কথা বলেছিল। এ কারণে প্রস্তুতি ছাড়াই উদ্বোধন করা হয়েছে। বর্তমান প্রশাসনের উচিত, দ্রুত পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু করা। এ ক্ষেত্রে দুই থেকে তিন বছরের জন্য কোরিয়া থেকে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক বিএসএমএমইউর রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল হান্নান বলেন, জনবল নিয়োগে শুরু থেকেই জটিলতা ছিল। ব্যবস্থাপনায়ও ছিল কিছু ভুলত্রুটি। নতুন করে আইনি কাঠামো তৈরি করে জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি অনুমোদন হলে হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু করা যাবে।
বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নূরুল হক বলেন, সাবেক ভিসির সময়ে চিকিৎসক নিয়োগে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এটির তদন্ত চলছে। জনবল নিয়োগ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়েছে। এটি সমাধানে কাজ চলছে। দ্রুত সময়ে বড় নিয়োগ আসবে।

জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, সমস্যা ও অনিয়মের কথা শুনেছি, বিশেষ করে জনবল নিয়োগে। এ কারণে এখনও পূর্ণাঙ্গরূপে এটি চালু করা যায়নি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তবে সবকিছু রাতারাতি পরিবর্তন হবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.