সরকারের দায়দেনা অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে অবস্থান পাকাপোক্ত করছে। ক্রমবর্ধমান দায়দেনা পরিস্থিতি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি চোখ রাঙাচ্ছে। শুধু বিদেশি ঋণ নয়, দেশের অভ্যন্তর থেকে নেওয়া ঋণও সরকারের দায়দেনা বাড়িয়ে চলেছে। বাজেটে অর্থের জোগান দিতে সরকারকে এখন আগের চেয়ে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। ফলে বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপ। পাশাপাশি ডলার-সংকট ও ডলারের বাড়তি দাম সরকারকে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে আরও বেশি চাপে ফেলেছে।
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পাঁচ বছরেই অভ্যন্তরীণ ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ যত অর্থ রাখা হয়েছিল, ১০ মাসেই সেই বরাদ্দ শেষ হয়ে গেছে। গত এক দশকে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ১০৮ শতাংশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বিদেশি ঋণ পরিশোধ ৩০০ কোটি ডলার বা ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
এর পাশাপাশি ডলারের চলমান সংকটের কারণে বিনিয়োগ থেকে পাওয়া মুনাফা এবং পণ্য ও সেবা বিক্রির অর্থ নিজেদের দেশে নিতে সমস্যায় পড়েছে বেশ কিছু বিদেশি কোম্পানি। আটকে থাকা এমন অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি ডলার, যা দেশের জন্য একধরনের দায়।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতির পর এখন সরকারের নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই দায়দেনা। দেশি-বিদেশি দায়দেনার এমন দুরূহ পরিস্থিতির মধ্যে ৬ জুন আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না, তাই দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর সরকারকে বেশি ভরসা করতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই ঋণের ভার আরও বাড়বে। বিদেশি ঋণে প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে এখন থেকে আরও সতর্ক থাকা উচিত। এসব ঋণের শর্ত, মেয়াদ, সুদের হার—এসব বিশ্লেষণ করতে হবে।’
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, এক-দুই বছর ধরেই দেশি-বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তাই কোন খাতে কত ঋণ, ঋণের উৎস কী, পরিশোধের পরিকল্পনা কী—এসব বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রীর একটি বিবৃতি থাকা উচিত। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একটি দেশের ঋণ পরিস্থিতি, পরিশোধের ক্ষমতা, বিনিয়োগের মুনাফা দেশে নিতে পারবে কি না—এসব দেখেই বিনিয়োগ করেন। বর্তমানে বেশ কিছু বিদেশি কোম্পানি মুনাফা দেশে নিতে ডলার-সংকটসহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে বাজেটের ঘাটতি পূরণে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে সরকার ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা ধার নেবে। এর মধ্যে ১ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা আসবে ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে। বাকি ১ লাখ কোটি টাকা নেওয়া হবে বিদেশি ঋণ হিসেবে।
পাঁচ বছরে দ্বিগুণ অভ্যন্তরীণ ঋণ
সরকারের দায়দেনার ক্ষেত্রে বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়েই সাধারণত বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু বাজেটের অর্থ জোগান দিতে অভ্যন্তরীণ উৎস যেমন ব্যাংক, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয় সরকার। এই ঋণের পরিমাণও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। গত পাঁচ বছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। দেশি ঋণের পরিমাণ এর আগে এত দ্রুত আর কখনো বাড়েনি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ৭৮ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এরপর প্রতিবছর ঋণের পরিমাণ শুধু বেড়েছেই। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাবে, এই পর্যন্ত (মধ্য মে পর্যন্ত) ব্যাংক খাত থেকে ৭০ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। বাজেটে অর্থের জোগান দিতে চলতি জুন মাসে বিভিন্ন ধরনের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে আরও ৬২ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে, অর্থাৎ মূলত সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে এ বছর ২৩ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার কথা। এ পর্যন্ত ১১ হাজার ২০৬ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে।
মূলত অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকারকে বাজেটঘাটতি মেটাতে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সঞ্চয়পত্র—এসবের দিকে নজর দিতে হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বিদেশি ঋণের জন্য বরাদ্দ অর্থ শেষ
বেশ কিছু দিন ধরেই বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়ছে। ফলে ১০ মাসেই বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ শেষ হয়ে গেছে। চলতি বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য স্থানীয় মুদ্রায় ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে ১০ মাসেই এ বাবদ খরচ হয়েছে ১২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে ডলারের হিসাবে বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ ১১৪ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। গত ১০ মাসে সব মিলিয়ে ২৮১ কোটি ডলারের বেশি সুদ ও আসল পরিশোধ করা হয়েছে, যা আগের বছরে একই সময়ের চেয়ে ৮৬ কোটি ডলার বেশি। চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩২৮ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ শোধ করতে হবে। ডলারের দাম বাড়ায় এর জন্য আরও বেশি স্থানীয় মুদ্রা দরকার হবে।
ইআরডির হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল হিসেবে সব মিলিয়ে ২৬৮ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। এক দশক আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১২৯ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ।
অন্যদিকে ঋণের ছাড় আগের তুলনায় খুব একটা বাড়েনি। ইআরডি সূত্র বলছে, জুলাই-এপ্রিল সময়ে সব মিলিয়ে ৬২৮ কোটি ডলারের ঋণ দেশে এসেছে।
ইআরডির কর্মকর্তারা বলেছেন, বিদেশি ঋণ এখনো নিরাপদ সীমার মধ্যে আছে। এই ঋণ পরিশোধে আপাতত কোনো সমস্যা হবে না। বিদেশি ঋণ ছাড়ও বাড়ছে। ফলে ঋণ পরিশোধে ডলার-সংকট হবে না।
আগামী বছরগুলোয় ঋণ শোধের চাপ আরও বাড়বে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৯-৩০ অর্থবছর নাগাদ ঋণ পরিশোধ বেড়ে দাঁড়াবে ৫১৫ কোটি ডলারে।
কেন বাড়ছে বিদেশি ঋণ শোধ
বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেশি বেড়েছে গত এক-দুই বছরে। ১০ বছর আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। গত এক দশকের ব্যবধানে ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বড় বড় প্রকল্পের বিদেশি ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হতে চলেছে এবং এটাই বিদেশি ঋণ শোধ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে নেওয়া ৫০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা থাকায় কিস্তির অর্থ রাশিয়ায় পাঠানো সম্ভব না হলেও তা বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষায়িত হিসাবে রাখা হচ্ছে। ওই হিসাবে গত দেড় বছরে তিন কিস্তিতে ৪৪ কোটি ডলার রাখা হয়েছে, যা ঋণ পরিশোধ হিসেবে দেখানো হয়েছে। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মূল প্রকল্পের জন্য ২০১৬ সালে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার দিয়েছে রাশিয়া। এই অর্থ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৬ সালে।
মেট্রোরেল-৬-এর জন্য নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধও শুরু হয়েছে। প্রতিবছর দুটি কিস্তিতে আগামী ৩০ বছর ধরে ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে।
চলতি বছরে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্পের। চীনকে আগামী ১৫ বছরে দিতে হবে ২৬০ কোটি ডলার। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন (পিইডিপি-৪) কর্মসূচির গ্রেস পিরিয়ড শেষ হচ্ছে এ বছর। এ প্রকল্পের প্রায় ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ শুরু হবে। এ ছাড়া ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য চীনের কাছ থেকে ১১০ কোটি ডলার নিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে গ্রেস পিরিয়ড শেষে ১৫ বছরে অর্থ শোধ করতে হবে।
বিদেশি কোম্পানির আটকে থাকা অর্থ
বাংলাদেশে ব্যবসা করছে, এমন বিদেশি কোম্পানির প্রায় ৫০০ কোটি ডলার আটকে আছে। তাঁরা বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফা এবং পণ্য বা সেবার বিক্রির অর্থ বিদেশে নিতে পারছে না। এ তালিকায় আছে জ্বালানি, এয়ারলাইনস, ভোক্তাপণ্য, শিল্পপণ্যসহ বিভিন্ন কোম্পানি। মূলত ডলার-সংকটের কারণে অর্থ বিদেশে নিতে পারছে না এসব কোম্পানি। এটিও সরকারের জন্য একধরনের প্রচ্ছন্ন দায়। কারণ, এই অর্থ নিতে দেওয়ার একধরনের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে সরকারের জন্য।
জানা গেছে, বেশ কয়েকটি বিদেশি এয়ারলাইনস কোম্পানির টিকিট বিক্রির পুরো অর্থ নিজেদের প্রধান কার্যালয়ে নিতে পারছে না। একটি জ্বালানি কোম্পানি তাদের মুনাফার বিপুল অর্থ দেশে নিতে পারছে না। এই অর্থ যাতে দ্রুত কোম্পানিগুলো নিজ দেশে নিতে পারে, সে জন্য বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রদূত সরকারি দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করছেন বলে জানা গেছে।
মোট ঋণ সাড়ে ১৬ লাখ কোটি টাকা
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ডিসেম্বর মাস শেষে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎসের ঋণ ৯ লাখ ৫৩ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণ ৭ লাখ ৫ হাজার ৫২০ কোটি টাকা।
ঢাকা