অভিযানে বন্ধ হাসপাতাল ক্লিনিক নীরবে চালু

0
115
ডাক্তার
নিবন্ধন না থাকায় গত বছর আগস্টে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের এসপিএ রিভারসাইড মেডিকেল সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে গত সাত মাসে প্রতিষ্ঠানটি আরও দুটি নতুন অবৈধ হাসপাতাল তৈরি করছে। এর মালিক এস এম ওসমানী আশ্রাফাবাদে রিভারসাইড হাসপাতাল এবং তাঁর ব্যবসার অংশীদার জাহিদ হাসান নিজ বাড়িতে মা ও শিশু ক্লিনিক গড়ে তুলছেন। তাঁদের একটিরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধন নেই।
নিবন্ধন ছাড়া কীভাবে হাসপাতালটি চালু হলো, জানতে এস এম ওসমানীর মোবাইল ফোনে কল করলে তাঁর পিএস এস এম শাকিল কথা বলেন। তিনি বলেন, এসপিএ রিভারসাইড মেডিকেল সেন্টারের নিবন্ধন না থাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বন্ধ করে দেয়। তবে রিভারসাইড হাসপাতালের জন্য ২০০৬ সালে নিবন্ধন নেওয়া। স্থান পরিবর্তন করে এখন নতুন অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশে বন্ধ করা হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ রোগী। অনেক সময় ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও।
গত বছর আগস্টে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে নিবন্ধন না থাকায় কামরাঙ্গীরচরের হাসান নগরে ইনান হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নূর ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার, বাংলাদেশে আই ট্রাস্ট হাসপাতাল, আলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ঢাকা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালট্যান্ট সেন্টারও বন্ধ করা দেওয়া হয়।
এর কয়েকদিন পরই সেগুলো ফের চালু হয়। অবশ্য এর মধ্যে দুই প্রতিষ্ঠানকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিবন্ধন দিয়েছে। তবে চিকিৎসার পরিবেশ, চিকিৎসা বর্জ্য রাখার জন্য আলাদা পাত্র ও জরুরি বিভাগে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক নিশ্চিত করার শর্ত থাকলেও তা বাস্তবায়ন করেনি এগুলো।
সরকার নির্ধারিত শর্ত পূরণ না করা পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই এসব প্রতিষ্ঠান চলছে।
নিবন্ধন ছাড়া ইনান হাসপাতাল কীভাবে চালু করা হলো– জানতে চাইলে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাহিদ হাসান বলেন, আবুল কাশেমের নামে হাসপাতালটির নিবন্ধন রয়েছে। সুষ্ঠুভাবে আমরা হাসপাতাল পরিচালনা করছি। সরেজমিন দেখা যায়, এখানে নেই পর্যাপ্ত জনবল। স্থায়ী চিকিৎসকও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ছোট দুটি তলা ভাড়া নিয়ে ১০ শয্যার একটি হাসপাতাল পরিচালনা করা হচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক দিয়ে চলছে কার্যক্রম।
গত বছরের ওই অভিযানে রাজধানীর খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার মুক্তি নার্সিং হোমও বন্ধ করা হয়েছিল। গত শনিবার গিয়ে সেটিও চালু পাওয়া যায়। এর মালিক ইফফাত আরা বেগম বলেন, ‘আবেদন করেছি, যে কোনো সময় হয়ে যাবে।’ বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে সরকার গত বছর দেশব্যাপী কয়েক দফা অভিযান চালায়। অভিযানে ১ হাজার ৮৯৯টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল। কিছু প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের আওতায় এলেও বড় অংশ নিয়মবহির্ভূতভাবেই চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান সাড়ে ২২ হাজার। এর মধ্যে গত ২৮ মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে ১৮ হাজার ৯০০টি। এখন পর্যন্ত নিবন্ধন পেয়েছে ১৩ হাজার ৯১১টি। সব শর্ত পূরণ না করাসহ নানা জটিলতায় নিবন্ধনের অপেক্ষায় ৪ হাজার ৯৪৯ প্রতিষ্ঠান। ৩ হাজার ৭০০ প্রতিষ্ঠান আবেদনই করেনি।
গত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিবন্ধন দেওয়া হয় ২০২২ সালে। এ বছর ১১ হাজার ১৮৩টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করে। ২০২১ সালে নিবন্ধন পায় ১০ হাজার ৭৩৫টি প্রতিষ্ঠান। চলতি বছর ১ হাজার ৯১টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরে একবার লোক দেখানো অভিযান এবং মাঠ পর্যায়ে নজরদারির অভাবেই এমন অরাজকতা চলছে। ফলে বেশি টাকা গুনেও হয়রানির শিকার হচ্ছেন মানুষ। অনেক সময় ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুও ঘটছে।
দেশের বেসরকারি হাসপাতালের মালিকদের একটি সংগঠন রয়েছে। নাম বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের সব হাসপাতাল ও ক্লিনিককে এ সংগঠনের সদস্য হতে হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা সংগঠনের সংখ্যা ২২ হাজার হলেও এ সংগঠনের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যে ৭ হাজার ৪৬৫টি ক্লিনিক পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ৪ হাজার ৭০৪টি আর হাসপাতাল ২ হাজার ৭৬১টি।
এ সংগঠনের সভাপতি মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, যাদের নিবন্ধন নেই, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. শেখ দাউদ আদনান বলেন, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অনেক প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হচ্ছে। তবে বন্ধ প্রতিষ্ঠান ফের চালু করা ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট থানায়ও কপি দেওয়া হয়। তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। তবে তা হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, অবৈধভাবে ফের চালু হওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হচ্ছে। সারাদেশের সিভিল সার্জনদের সঙ্গে আলোচনা করে ফের অভিযান পরিচালনা করা হবে। তবে শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একার পক্ষে এসব অবৈধ হাসপাতাল বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সম্পৃক্ততা দরকার।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, দেশের অধিকাংশ মানুষ অবৈধ সুবিধা নিয়ে চলে। তাই রাতারাতি এ সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসেবায় শৃঙ্খলা ফেরাতে স্থানীয় পর্যায়ে একটি শক্ত কমিটি প্রয়োজন।
তবিবুর রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.