সরকারবিরোধী আন্দোলনের অভিন্ন রূপরেখা নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এক পক্ষ মনে করছে, নতুনভাবে রূপরেখা ঘোষণা আন্দোলনের গতিকে ধীর করবে। অন্য পক্ষ বলছে, সবার মতামতের ভিত্তিতে রূপরেখা ঘোষণার বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছে। রূপরেখা তৈরির কাজও প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন তা বাস্তবে রূপদান না করলে সমমনা দলের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে।
গত সোমবার সাতদলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে খসড়া রূপরেখা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় সেটি উপস্থাপন করা হয়। তবে তা চূড়ান্ত করা হয়নি। কয়েকদিনের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সরকার পরিবর্তনে বিএনপির ১০ দফা দাবি ও রাষ্ট্র মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখার সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চ ঘোষিত ১৪ দফার সমন্বয়ে নতুন অভিন্ন ঘোষণাপত্র তৈরিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে দু’পক্ষের লিয়াজোঁ কমিটি। ২ মে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক শেষে বলা হয়, আগামীর বাংলাদেশ কেমন হবে, তার রূপরেখার যৌথ ঘোষণা শিগগির দেওয়া হবে। গণতন্ত্র মঞ্চসহ যেসব দল আন্দোলনে আছে, তারা সবাই মিলে জাতির সামনে এই রূপরেখার ঘোষণা দেবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েকজন নেতা অভিযোগ করেন, তাঁদের ওই বৈঠকের পরই নাটকীয়ভাবে বিএনপির রূপরেখা নিয়ে ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করছে। আগের মতো এটাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অভিন্ন রূপরেখা নিয়ে কাজ চলমান রয়েছে। তবে কবে ঘোষণা করা হবে সেটা তাঁদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটা নিয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না।
জানা গেছে, বিএনপির কোনো কোনো নেতা মনে করছেন, এখন এক দফার ভিত্তিতেই আন্দোলন করা দরকার। এতে সফল হলে সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনসহ রাষ্ট্র মেরামতে ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁদের এ ঘোষণার মধ্যে সমমনা অন্যান্য দল ও জোটের দাবি এবং প্রত্যাশার সবকিছুই রয়েছে। তাই এখন নতুন করে রূপরেখা ঘোষণা দেওয়া হলে নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চ ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনে শরিক অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও অভিন্ন রূপরেখা নিয়ে তেমন আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। তাঁদের মতে, আগে আন্দোলন সফল হোক, তার পর দাবি-দাওয়া আর প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করা যাবে। তাই আগে আন্দোলন, পরে রূপরেখা।
গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে ৩৫ দফা রূপরেখার খসড়া প্রস্তাবনা বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির ঘোষিত ২৭ দফা রূপরেখার প্রায় সব ক’টি এতে রাখা হয়েছে। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘সরকার ও শাসনব্যবস্থা বদলের লক্ষ্যে যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণা।’ এতে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তির দাবি করা হয়েছে। আন্দোলনে সফলতার পর রাষ্ট্র মেরামতেও রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।
রূপরেখায় সরকারের পদত্যাগ, দলনিরপেক্ষ কিংবা নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনসহ ৯টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন ইস্যুতে বলা হয়েছে, বর্তমান অবৈধ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে সরকারকে অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির ইস্যুতে দেওয়া দুই দফায় একটিতে খালেদা জিয়াসহ সব নেতাকর্মীর মুক্তির দাবি করা হয়েছে এবং অন্যটিতে নির্বাচন-পরবর্তী সম্ভাব্য সহিংসাত মোকাবিলায় সবার সম্মিলিত কমিশন গঠন করে ইউনিয়ন পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরকালীন নিরাপত্তা কাঠামো তৈরির বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্থায়ী সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের সাংবিধানিক কাঠামো প্রবর্তন; রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা; নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতায় যৌক্তিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা; ন্যায়পাল ও সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া পরপর দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে কেউ আসীন না হওয়ার বিধান প্রবর্তন; দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং সংসদের দুই কক্ষের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে সরকার গঠনে আস্থা ভোট ও বাজেট পাস বিল ব্যতিরেকে সব বিলে স্বাধীন মতামত প্রদান ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার নিশ্চিয়তা বিধানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
রূপরেখায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল; গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ এবং এর আগে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ড, গুম, খুনের যথাযথ তদন্ত এবং দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার; চিন্তা, মত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার ও সর্বজনীন মানবাধিকার কার্যকর; দুর্নীতি-লুটপাট বন্ধ, গণমুখী প্রশাসন, স্বাধীন গণমাধ্যম ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে বিভিন্ন বিষয় রয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চের খসড়া রূপরেখায়। গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, তাঁরা অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণার বিষয়ে কাজ করছেন।