রুশ-বাংলাদেশিদের বন্ধুত্বে বদলে যাওয়া এক জনপদ

0
192
ঈদের ছুটিতে কেনাকাটা করতে বের হয়েছেন রূপপুর পারমানবিক প্রকল্পে কর্মরত রাশিয়ার নাগরিকেরা। গ্রীন সিটি, নতুন হাট, ঈশ্বরদী, পাবনা, ২৩ এপ্রিল

‘রাশিয়ার নাগরিকেরা এখন আমাদের সঙ্গে মিশে গেছেন। বন্ধু বলতে না পারায় তাঁরা আমাদের বন্দু বলে ডাকেন। প্রথম দিকে আমরা রুশদের বন্ধু বলে ডাকতাম। পরে তাঁদের মুখে সেটা বন্দু হয়ে ফিরে এসেছে।’

কথাগুলো বলছিলেন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়নের দিয়াড় সাহাপুর গ্রামের নতুনহাট নামের ছোট্ট বাজারের মাংস ব্যবসায়ী রজব আলী।

নিজে অক্ষরজ্ঞানশূন্য জানিয়ে রজব আলী বলেন, রুশ ভাষা তো দূরে থাক, পৃথিবীতে রাশিয়া নামের কোনো দেশ আছে, সেটাই তিনি জানতেন না। রুশদের সঙ্গে যোগাযোগ হতে হতে এখন তাঁদের ভাষার কিছু শব্দ রপ্ত করেছেন। আর রুশরাও এখানকার আঞ্চলিক ভাষা টুকটাক বুঝতে পারেন।

এটা শুধু নতুনহাটের চিত্র নয়, উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারেও একই দৃশ্যের দেখা মেলে। রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে এলাকাটির এমন বদল ঘটেছে।

রূপপুর পারমানবিক প্রকল্পের সুউচ্চ চুল্লিগুলো অনেক দুর থেকে দেখা যায়। পাকশী, ঈশ্বরদী, পাবনা, ২৪ এপ্রিল
রূপপুর পারমানবিক প্রকল্পের সুউচ্চ চুল্লিগুলো অনেক দুর থেকে দেখা যায়। পাকশী, ঈশ্বরদী, পাবনা, ২৪ এপ্রিল

দিয়াড় সাহাপুর গ্রামের আবাসিক এলাকা গ্রিনসিটির সামনের ভ্রাম্যমাণ বাজারের বিভিন্ন পোশাকের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ী ওমর আলী। তাঁর পাশেই মেহেদী হাসান নামের স্থানীয় এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিক্রি করছেন আপেল-কমলাসহ বিভিন্ন ধরনের ফল। বাংলাদেশি ও বাংলাভাষী এ দুই ব্যবসায়ীর দোকান থেকে যাঁরা পোশাক ও ফল কেনেন, তাঁদের প্রায় সবাই রাশিয়ার নাগরিক।

দুই দেশ ও দুই ভাষার মানুষ হলেও কেনাবেচায় সমস্যা হচ্ছে না। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা যেমন কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো করে বুঝতে পারছেন রুশ ভাষা, তেমনি বাংলা ভাষা বুঝে নিচ্ছেন রাশিয়ার এসব নাগরিক। এভাবে খাবার থেকে শুরু করে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানেও দেখা মেলে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ বিনিময়।
ফল বিক্রেতা মেহেদী হাসান বলেন, ‘রুশদের অনেক ধৈর্য। প্রথম দিকে ইশারায় কথা বলতাম। তাঁরা ধৈর্য নিয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করতেন। এখন প্রয়োজনীয় শব্দগুলো আমাদেরও মোটামুটি আয়ত্তে এসে গেছে।’

ঈদের ছুটিতে সন্তানদের নিয়ে  বের হয়েছেন রূপপুর পারমানবিক প্রকল্পে কর্মরত রুশ নারী। গ্রীন সিটি, নতুন হাট, ঈশ্বরদী, পাবনা, ২২ এপ্রিল
ঈদের ছুটিতে সন্তানদের নিয়ে বের হয়েছেন রূপপুর পারমানবিক প্রকল্পে কর্মরত রুশ নারী। গ্রীন সিটি, নতুন হাট, ঈশ্বরদী, পাবনা, ২২ এপ্রিল

এ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে পদ্মা নদীর তীরঘেঁষা ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর গ্রামে। প্রকল্পের আবাসিক এলাকা ‘গ্রিনসিটি’ নির্মিত হয়েছে পার্শ্ববর্তী দিয়াড় সাহাপুর গ্রামে। নতুন এই সিটিতে ২০ তলাবিশিষ্ট ১৭টি ভবন তৈরি হয়েছে। আরও কয়েকটি ভবন নির্মাণাধীন।

একসময় পুরো গ্রাম ছিল ধানের চাতালের দখলে। শত শত ট্রাকের কারণে ধুলাবালুতে গ্রামের মানুষ অতিষ্ঠ থাকত জানিয়ে উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এখন আমাদের গ্রাম শহরে পরিণত হয়েছে। রুশরা গ্রামে গ্রামে বেড়াতে যান। মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা গ্রামের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। তাঁদের দেখাদেখি গ্রামের মানুষের আচরণেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলগামী হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে একটি আন্তরিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বিষয়টি দেখতে ভালো লাগে।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে পুরো এলাকাটি ছিল জঙ্গলময়। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশরা রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের পর থেকে এ এলাকায় জনবসতিসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সূচনা হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন হয় ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর। তখন থেকেই রাশিয়ার নাগরিকেরা আসতে শুরু করেন। নতুন করে প্রাণ পেতে শুরু করে এলাকাটি।
বর্তমানে সাড়ে ৫ হাজার রাশিয়ান কর্মী কাজ করছেন এ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে। তাঁদের মধ্যে প্রায় ২ হাজার নারী। তবে এসব কর্মীর কারও পরিবার এখানে থাকে না।
সম্প্রতি প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিদেশি এসব কর্মীর জন্য বিপণিবিতান, সুপারশপ, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, বার, হাসপাতাল ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে দিয়াড় সাহাপুরসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে। সাইনবোর্ডে এসব প্রতিষ্ঠানের নাম রুশ ও বাংলা হরফে লেখা হয়েছে। ফলে হঠাৎ করে দেখলে এখন গ্রামটিকে একখণ্ড রাশিয়া মনে হয়।

রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ শোধ হবে চীনা মুদ্রায়

প্রকল্পের সাইট ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকল্পের ভেতরে ও বাইরে সবখানেই রুশদের আচরণ বেশ আন্তরিক। আমাদের দেশের মানুষের সঙ্গে মিশে গেছেন তাঁরা। বাংলাদেশিদের সঙ্গে রুশদের এই সম্প্রীতি রূপপুর প্রকল্পকে আরও গতিময় করেছে।’

পাবনা-কুষ্টিয়া মহাসড়ক থেকে ঢালু রাস্তা ধরে নামলেই দিয়াড় সাহাপুর গ্রাম। ছোট রাস্তার পাশেই ‘নতুনহাট’ নামের শাকসবজি, ফল, মাছ-মাংসের ছোট্ট বাজার। ওই বাজারে গিয়ে দেখা যায়, রাশিয়ার নাগরিকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

বাজারের সবজি বিক্রেতা কোরবান আলী বলেন, ‘রুশরা বেশ মিতব্যয়ী, আমাদের মতো অনেক বাজার করেন না। হিসাব করে অল্প অল্প কেনেন। সবজি পছন্দ করেন, তবে ঝালটা অপছন্দ।’

নতুনবাজার থেকে বেরোলেই গ্রিনসিটি। এর সামনে দিয়ে সামনে এগোলেই আধুনিক সব দোকানপাট, সেলুন, রেস্তোরাঁ। মুঠোফোন থেকে শুরু করে জামাকাপড়, খাদ্যসামগ্রীসহ প্রয়োজনীয় সব পণ্য পাওয়া যায় এখানে।

বাজারের একটি কাপড়ের দোকানের কর্মী শাহরিয়ার হোসেন বলেন, রুশরা বন্ধুসুলভ। খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যান। কথায় কথায় ধন্যবাদ দেন, সম্মান জানান। তাঁদের দেখাদেখি এখানকার মানুষের মধ্যেও বেশ পরিবর্তন আসছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.