বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় জাপান বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। এটি জাপানের দৃঢ় আশা বলেও জানান তিনি। ২০১৮ নির্বাচন সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি (গত নির্বাচনে) পুলিশ কর্মকর্তারা নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভোট দিয়ে ভর্তি করে ফেলেছেন। এ ধরনের ঘটনা এর আগে অন্য কোনো দেশে আমি শুনিনি। এ ধরনের ঘটনা আর কখনোই দেখতে চায় না জাপান। সরকার আমাদের জানিয়েছে যে আগামী নির্বাচন অবাধ ও স্বচ্ছ হতে যাচ্ছে। ফলে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এতে অংশগ্রহণ করবে এটিই আমার আশা।’
রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় সোমবার ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসাডর’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে জাপানি রাষ্ট্রদূত এ মন্তব্য করেন। সিরিজ অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে থাকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এবং একটি জার্মান সামাজিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠান ফ্রেডরিক-এবার্ট-স্টিফটুং, বাংলাদেশ (এফইএস, বাংলাদেশ)। অনুষ্ঠানে এবারের অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি।
তিন পর্বের অনুষ্ঠানের প্রথম অংশে ছিল রাষ্ট্রদূতের বক্তৃতা এবং দ্বিতীয় অংশে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে একটি আলোচনা পর্ব। অনুষ্ঠানের শেষ অংশে ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব, যেখানে আমন্ত্রিত সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদেরা সরাসরি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেছেন। এতে সূচনা বক্তব্য দেন সিজিএসের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী এবং সঞ্চালনা করেন নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ইতো নাওকি বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের পরই ঢাকার জাপান দূতাবাস উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি প্রকাশ করে। এ বিষয়টি বেশ অস্বাভাবিক, কারণ দূতাবাস এ ধরনের কাজ করে না। জাপান আশা করে আগামী নির্বাচন ভালো হবে, অবাধ ও স্বচ্ছ হবে।’
নির্বাচন নিয়ে রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য ব্যক্তিগত নাকি জাপান সরকারের- জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে জাপান সরকারের প্রতিনিধি। আমার বক্তব্য হচ্ছে জাপান সরকারের বক্তব্য।’
বাংলাদেশে ভোটার শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থায়নের ব্যাপারে তিনি সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেন এবং এ ব্যাপারে তিনি জাপান সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন।
আগামী ২৯ নভেম্বর তিন দিনের সফরে জাপানে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই পটভূমিতে অবাধ, স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে জাপানে প্রধানমন্ত্রীর সফরে কোনো আলোচনা হবে কিনা- প্রশ্ন করা হলে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এটি প্রধানমন্ত্রীর বিষয়, তিনি আলোচনায় কোন বিষয়টি রাখবেন, আর কোনটি রাখবেন না।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘জাপান সরকার মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে সহিংসতা বন্ধে ও গণতান্ত্রিক ধারা ফেরত আনার বিষয়ে আলোচনা করছে। জাপান রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পক্ষে এবং অন্যান্য বেসরকারি ও উন্নয়ন অংশীদারের মতো জাপানও রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সাহায্য করে যাচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে কিছু রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করা গেলেও পুরো দমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সংকটটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’
ইতো নাওকি বলেন, ‘বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে জাপান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে জাপান বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল, মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে বিশেষভাবে সাহায্য করছে। বাংলাদেশের সকল উন্নয়ন চ্যালেঞ্জের পাশে থাকবে জাপান। তবে এক্ষেত্রে ঋণের ফাঁদের বিষয়টিও আমলে নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার জাপান। স্বাধীনতার পরপরই স্বীকৃতি দেওয়া ও পুনর্গঠনে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বছরে ৩০০ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহযোগিতা বা ওডিএ দিয়ে আসছে টোকিও। জাপানের বিপুল বিনিয়োগ বাংলাদেশে রয়েছে। জাপানের জন্য বরাদ্দ বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিপুল পরিমাণের বিনিয়োগ আনতে যাচ্ছে দেশটি। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম শুরু করবে।
বিশ্বে পশ্চিমাদের উদার গণতান্ত্রিক ধারা হুমকির মুখে রয়েছে এবং সংকুচিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্নেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। সমকালকে তিনি বলেন, ‘উদার গণতন্ত্রের পরিবর্তে এর নানা ধরনের শাখা-প্রশাখা বের হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে অন্তর্ভুক্ত বলে বাংলাদেশে জবাবদিহিহীন বা হাইব্রিড গণতান্ত্রিক সরকার থাকলে তা উদ্বেগের বিষয়। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে জাপানের ভাবনা রয়েছে। তারা চায় যত দেশ সম্ভব এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হোক। ফলে বাংলাদেশে যদি আবারও আগের দুটি নির্বাচনের মতো অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়, এতে তাদের স্বার্থে আঘাত আসবে।’