অবসরপ্রাপ্ত মেজর জলিল কোথায়, জানে না পুলিশ

0
78
মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নাজমুল হুদা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার; এই তিন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার ৪৭ বছর পর হওয়া মামলায় মেজর (অব.) জলিলকে প্রধান আসামি করা হয়েছে

কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা হত্যা মামলায় প্রধান আসামি অবসরপ্রাপ্ত মেজর আবদুল জলিল এখন কোথায় রয়েছেন, সে ব্যাপারে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে তিনি জীবিত আছেন। বছর দুয়েক আগেও রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। এরপর তাঁর অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, তিনি এখন দেশের বাইরে থাকতে পারেন। তাঁর অবস্থান জানার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদের এমপি হোস্টেলে কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রমকে হত্যা করে এক দল সেনাসদস্য। সেখানে সেদিন তাঁর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দুই সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তমকেও হত্যা করা হয়। এই হত্যা মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে মেজর (অব.) আবদুল জলিলকে।

হত্যাকাণ্ডের ৪৭ বছর পর দায়ের করা মামলায় সাবেক সেনাপ্রধান ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জিয়াউর রহমান এবং জাসদের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রয়াত লে. কর্নেল আবু তাহেরকেও হুকুমের আসামি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থানের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেছিলেন জিয়াউর রহমান। লে. কর্নেল আবু তাহের তখন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) গণবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থেকে সেই অভ্যুত্থানে ভূমিকা রেখেছিলেন।

এত বছর পর এই মামলা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। মামলাটি করেছেন কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদার মেয়ে ও সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান।

কর্নেল নাজমুল হুদা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৮ নম্বর সেক্টরে একটি সাবসেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেছিল, সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একজন ছিলেন কর্নেল নাজমুল হুদা।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কর্নেল নাজমুল হুদাকে হত্যার ঘটনায় এখন মামলা দায়েরের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই মামলা করার ক্ষেত্রে সরকারের ইঙ্গিত থাকতে পারেও বলে মনে করছে দলটি।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার যেকোনো সময় মামলা করতে পারে। এখন পরিবার থেকে মামলা হয়েছে এবং তা তদন্ত করা হচ্ছে।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হঠাৎ মামলা করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যখন আন্দোলন করছে, সে পটভূমিতে ঘটনার এত বছর পর এসে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য সরকার পেছনে থেকে এই মামলা দিয়েছে।

মেজর আবদুল জলিল কে

সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৭৫ সালের পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছেন এম এ হামিদ। পরে তিনি লে. কর্নেল হিসেবে অবসরে যান। সেই সময়কার ঘটনাগুলো নিয়ে ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ শিরোনামে তিনি বই লিখেছেন। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালের মে মাসে। লে. কর্নেল এম এ হামিদ মারা যান ২০০৮ সালের ২৫ জুলাই।

কর্নেল (অব.) হামিদ তাঁর বইয়ে খালেদ মোশাররফ, এ টি এম হায়দার ও খন্দকার নাজমুল হুদা হত্যাকাণ্ডের কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, মেজর জলিল কয়েকজন উত্তেজিত সৈনিককে নিয়ে শেরেবাংলা নগরে মেসের (এমপি হোস্টেল) ভেতরে প্রবেশ করেন। এরপর সেখানে তিনজনকে একে একে হত্যা করা হয়। তবে বইয়ে সেদিনের ঘটনাপ্রবাহে একজন মেজর জলিলের নাম এলেও তাঁর পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ নেই।

লে. কর্নেল এম এ হামিদ তাঁর বইয়ে যে মেজর জলিলের কথা বলেছেন, তিনি ওই সময়কার জাসদ নেতা মেজর এম এ জলিল নন বলেই নিশ্চিত করেন সেনাবাহিনীর সাবেক একজন কর্মকর্তা। এই কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, মামলায় নাম আসা মেজর (অব.) আবদুল জলিল ১৯৭১ সালে ক্যাডেট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ৬০ জন ক্যাডেট সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ওই ক্যাডেটদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলা হয়ে থাকে। ওই কমিশনপ্রাপ্তদের একজন ছিলেন আবদুল জলিল।

সেনাবাহিনীর আরও দুজন সাবেক কর্মকর্তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে। তাঁরা দুজন দুটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা জানিয়েছেন, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। মেজর জলিলও দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলেন। নাজমুল হুদা সে সময় পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থানের মধ্যে তাঁর ব্রিগেডের সাত শ সৈনিককে নিয়ে খালেদ মোশাররফের সমর্থনে রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি সৈনিকদের নিয়ে শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদের মেসে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখানেই হত্যাকাণ্ড ঘটে।

মেজর আবদুল জলিল কবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন এবং পরে তিনি কী করেছেন—এসব প্রশ্নে সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তারা কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

আবদুল জলিল কোথায়?

আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর কাছে মেজর জলিলের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কেয়কজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, মেজর আবদুল জলিল বিদেশে রয়েছেন বলে তাঁরা ধারণা করছেন। কিন্তু কোন দেশে থাকতে পারেন, সেটি তাঁদের জানার মধ্যে নেই। এমনকি কবে, কখন দেশ ছেড়েছেন, সে বিষয়েও কোনো তথ্য তাঁদের কাছে এ মুহূর্তে নেই। আবার কারও কারও ধারণা, মেজর জলিল হয়তো দেশেও থাকতে পারেন। গত চার দশকে তাঁকে নিয়ে কোনো আলোচনাও ছিল না। তিনিও কোনো রাজনৈতিক সবা সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সামনে আসেননি। ফলে তাঁর বিষয়ে কারও তেমন আগ্রহ ছিল না।

কর্নেল নাজমুল হুদাকে হত্যার ঘটনায় তাঁর মেয়ে যে মামলা করেছেন, সেই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, দশম ইস্ট বেঙ্গলের কর্মকর্তা, জেসিও এবং সৈনিকদের সঙ্গে মেজর (অব.) মো. আসাদ উজ্জামান, মেজর (অব.) মো. আবদুল জলিল হত্যার উদ্দেশ্যে তিন সেনা কর্মকর্তা নাজমুল হুদা, খালেদ মোশাররফ ও এ টি এম হায়দারকে গুলি করেন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে গুলি করার পর তাঁদের বেয়নেট দিয়ে আঘাত করা হয়। এজাহারে ঘটনার বর্ণনায় হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে মেজর জলিলের সঙ্গে আরেকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) মো. আসাদ উজ্জামানের নাম এসেছে। তবে আসাদ উজ্জামান কয়েক মাস আগে মারা গেছেন। মামলার এজাহারে আবদুল জলিল জীবিত রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলার বাদী নাহিদ ইজাহার খানও সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁর বাবার হত্যাকারীদের মধ্যে আবদুল জলিল জীবিত থাকায় তাঁর নাম উল্লেখ করেই আসামি করা হয়েছে। পরে বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলো তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু তিনি এ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মামলার তদন্তে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে।

মামলার বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ, নাজমুল হুদাসহ তিনজনকে হত্যার সেই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার তখন বিচার চাইতে পারেনি।
মাহবুব উল আলম হানিফ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ

৪৭ বছর পর এই মামলা কেন

১৯৭৫ সালে পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থানের মধ্যে ক্ষমতায় এসে পরে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ক্ষমতায় থেকে তিনি রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হঠাৎ মামলা করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যখন আন্দোলন করছে, সে পটভূমিতে ঘটনার এত বছর পর এসে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য সরকার পেছনে থেকে এই মামলা দিয়েছে।

কর্নেল আবু তাহের জাসদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁকেও মামলায় হুকুমের আসামি করা হয়েছে। জাসদের একাংশ এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটে রয়েছে। জাসদের নেতা হাসানুল হক ইনু অবশ্য মামলার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দীর্ঘ সময় পর হলেও ঘটনার ব্যাপারে সত্যের অনুসন্ধান প্রয়োজন। তবে তিনি এটিও মনে করেন, লে. কর্নেল আবু তাহেরের (অব.) নাম এই মামলায় যুক্ত করায় প্রকৃত ঘটনা, তথ্য ও সত্য আড়ালে চলে যাবে।

ইনুর এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, মামলার বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ, নাজমুল হুদাসহ তিনজনকে হত্যার সেই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার তখন বিচার চাইতে পারেনি। তিনি দাবি করেন, এখন উপযুক্ত সময় মনে করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার মামলা করেছে, এর পেছনে সরকারের কোনো হাত নেই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.