অন্তর্বর্তী সরকারের ১ মাস: স্থবির অর্থনীতি সচলের চেষ্টা

0
50
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ১৩ উপদেষ্টা। ঢাকার বাইরে থাকায় তিনজন শপথ নিতে পারেননি

কয়েক বছর ধরেই নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। গত দুই বছরে এ সংকট আরও গভীর হয়েছে। ডলারের তীব্র সংকট, ঋণের নামে ব্যাংক লুটপাট আর বিদেশে অর্থ পাচার অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণের মাত্রা কেবল জোরালো করেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে সাধারণ মানুষ রীতিমতো পিষ্ট হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যানের মাধ্যমে অর্থনীতির একটি ভালো চেহারা দেখানোর চেষ্টা হলেও তা জনজীবনে স্বস্তি আনতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণ রেখে বিদায় নিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল, সংকট নিরসনে সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়া। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া এবং তা বাস্তবায়নে যে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার দেখানোর প্রয়োজন ছিল, সেটিও করতে পারেনি সদ্য ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার। বরং স্বজনতোষী বিভিন্ন পদক্ষেপ ও গোষ্ঠীর স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যস্ত ছিল এই সরকার, যার সুবিধা পেয়েছেন মূলত গুটিকয় ব্যবসায়ী আর ক্ষমতাসীনদের আত্মীয়–পরিজন। অনেকটাই বিকল হয়ে পড়েছিল পুরো অর্থনীতি।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এতে শিল্প খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বাজারঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। চাঁদা নেওয়ার খেলোয়াড়ের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।

জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, ঢাকা কার্যালয়

টানা ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকেও অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধে আওয়ামী লীগ সরকার যেসব উদ্যোগ নিতে পারেনি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার ৩০ দিনের মধ্যেই সেসব উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে। অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। বিশেষ করে আর্থিক খাতে এ বার্তা দেওয়া হয়েছে যে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে ব্যাংক দখল করে নামে–বেনামে ঋণ নেওয়ার দিন শেষ হয়েছে।

গত এক মাসে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্ব এসেছে। অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে শ্বেতপত্র প্রণয়নে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে অর্থনীতি আর আর্থিক খাতের পুনর্গঠনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এ বিষয়ে পরিষ্কার একটি বার্তাও এসেছে অর্থনীতিবিষয়ক নেতৃত্বের কাছ থেকে। তবে নীতি সুদহার কিছুটা বাড়ানো ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখনো বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসায় শিল্প খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। বিশেষ করে আর্থিক খাতে এ বার্তা দেওয়া হয়েছে যে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে ব্যাংক দখল করে নামে–বেনামে ঋণ নেওয়ার দিন শেষ হয়েছে।

অর্থনীতির যা অবস্থা

গত কয়েক দশকের মধ্যে অর্থনীতি এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে। সামষ্টিক অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই তলানিতে। গত জুলাইয়ে ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতি গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশের ওপরে আছে।

নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার চর্চা থেকে বের হননি ক্ষমতার বলয়ে থাকা একশ্রেণির ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদেরই কেউ কেউ একে ঋণের নামে অর্থের লুণ্ঠন হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৯০ কোটি টাকা। মূলত ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেওয়া ও লুটপাটের ব্যাপারে চোখ বন্ধ করার নীতি নেওয়ার কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ব্যাংক খাতের নীতিনির্ধারণ হয়েছে ক্ষমতার বলয়ে থাকা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায়—এমন অভিযোগও আছে।

বাজেটে ঘাটতি অর্থায়ন করার কারণে বিগত সরকার দেদারে দেশি–বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে। গত জুন মাস পর্যন্ত সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে ঋণের বোঝা বেড়েছে সাড়ে ছয় গুণ, যা বর্তমান বাজেটের তিন গুণের সমান। বাছবিচারহীনভাবে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়ায় বাজেটের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। এখন প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের অর্থ চলে যাচ্ছে ঋণ পরিশোধে।

ডলার–সংকট এখনো চলমান। ৮৬ টাকার ডলার ১২০ টাকায় উঠেছে। আমদানি খরচ বেড়েছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির সুখবর গত দুই বছরে ছিল না। অর্থনীতির আকার অনুসারে পর্যাপ্ত রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি—এসব পুরোনো সমস্যার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৯০ কোটি টাকা। মূলত ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেওয়া ও লুটপাটের ব্যাপারে চোখ বন্ধ করার নীতি নেওয়ার কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

নেতৃত্বে পরিবর্তন

নতুন সরকার আসার পর অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে নেতৃত্বের বড় পরিবর্তন হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। দুজনেই বিগত সরকারের আমলে অর্থনীতির লুটপাট নিয়ে আগে সমালোচনা করেছেন।

ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরকে। তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) উচ্চপদে কাজ করেছেন। শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আগের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আর অফিস করেননি। তাঁকে প্রকাশ্যেও দেখা যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, তিনি এস আলমসহ সরকার–ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের নানা ধরনের সুবিধা দিয়েছেন।

অন্যদিকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানসহ নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। এর আগে বিএসইসির চেয়ারম্যান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলাম। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একেবারে শেষ মুহূর্তেও তিনি বিশেষ সুবিধা দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে।

ডলার–সংকট এখনো চলমান। ৮৬ টাকার ডলার ১২০ টাকায় উঠেছে। আমদানি খরচ বেড়েছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির সুখবর গত দুই বছরে ছিল না। অর্থনীতির আকার অনুসারে পর্যাপ্ত রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি—এসব পুরোনো সমস্যার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সচিব আবদুর রহমান খান। তিনি কর ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন এবং এনবিআরের কাজকর্মের পরিধি সম্পর্কে জানেন। এনবিআরের আগের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। ব্যবসায়ীরা তাঁর ব্যাপারে সমালোচনামুখর ছিলেন। তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা।

রিজার্ভের ক্ষয়

দুই বছর আগে শুরু হওয়া ডলারের সংকট কাটেনি। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে সাবেক সরকারের সময়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো রিজার্ভ বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, আমদানি নিয়ন্ত্রণের পরও প্রতি মাসে দায় মেটানোর জন্য গড়ে কমবেশি ৫০০ কোটি ডলার প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে প্রকৃত রিজার্ভের অর্থ দিয়ে মোটামুটি তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো যেতে পারে।

গত বছর ডলারের দাম নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন আন্তব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যান্ড ছিল ১ শতাংশ। ১৮ আগস্ট এই ব্যান্ড আড়াই শতাংশ করার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে ডলারের মধ্যবর্তী দাম দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ১২০ টাকা। এ সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাংকগুলো এখন ডলারের দাম কিছুটা বেশি দিতে পারছে, ফলে বাড়ছে প্রবাসী আয়।

প্রকৃত পরিসংখ্যান প্রকাশ

দেশে গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে জুলাই মাসে। এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে আগস্ট মাসে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর। মূল্যস্ফীতির সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই প্রশ্ন করে আসছিলেন। সব পণ্য ও সেবার দাম হু হু করে বাড়লেও মূল্যস্ফীতির হারকে দুই অঙ্কের ঘর পার হতে দেখা যায়নি। তবে আগস্টে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে মূল্যস্ফীতিও যেন লাফ দিয়ে বেড়ে যায়। অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, সময়মতো ‘প্রকৃত তথ্য–উপাত্ত’ প্রকাশ করা হবে। তিনি মনে করেন, যথাযথ নীতি প্রণয়নের জন্য প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত দরকার।

সব পণ্য ও সেবার দাম হু হু করে বাড়লেও মূল্যস্ফীতির হারকে দুই অঙ্কের ঘর পার হতে দেখা যায়নি। তবে আগস্টে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে মূল্যস্ফীতিও যেন লাফ দিয়ে বেড়ে যায়।

ব্যাংক খাত এস আলমমুক্ত

রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ইসলামী ব্যাংকসহ অন্তত আটটি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল এস আলম গ্রুপ। অন্য ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। গত এক মাসে আর্থিক খাতে সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান পদক্ষেপ হলো এসব ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন পর্ষদ গঠনের মাধ্যমে এসব ব্যাংক এস আলমমুক্ত করেছে।

ভেঙে দেওয়া হয়েছে আরও কয়েকটি ব্যাংকের পর্ষদ, যেগুলো সরকার-ঘনিষ্ঠরা নিয়ন্ত্রণ করত।

এস আলম গ্রুপ ব্যাংক ও আর্থিক খাত থেকে নামে-বেনামে যে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, তা কীভাবে উদ্ধার করা হবে, তা অবশ্য এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঋণ আদায় না হলে ব্যাংক খাতের ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

পর্ষদ ভাঙা হয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকেরও। সাবেক মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মুসলিম চৌধুরীকে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এ ছাড়া ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবু আহমেদকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এস আলম গ্রুপ ব্যাংক ও আর্থিক খাত থেকে নামে-বেনামে যে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, তা কীভাবে উদ্ধার করা হবে, তা অবশ্য এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঋণ আদায় না হলে ব্যাংক খাতের ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

শ্বেতপত্র কমিটি গঠন

নির্দিষ্ট ও স্বল্প আয়ের মানুষ জীবন চালাতে হিমশিম খেলেও সাবেক সরকার সব সময় অর্থনীতির একটি রঙিন চিত্র এঁকে গেছে। তবে অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা জানতে এখন একটি শ্বেতপত্র তৈরি করা হবে। গত ২৯ আগস্ট বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারা, কীভাবে দুর্নীতি করেছে, এ কমিটি তা ধরবে না। তবে গত কয়েক বছরের অর্থনীতির গতিধারা বিশ্লেষণ করে অর্থনীতির সংকট ও চ্যালেঞ্জ নির্ধারণ করবে এবং সমাধানের পথও বাতলে দেবে তারা।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবে বলে কথা রয়েছে। যদি কোনো খাতের প্রতিবেদন আগেই তৈরি হয়ে যায়, তাহলে তা অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশ করা হবে।

যা হয়নি

গত দেড় দশকে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। এ খাত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে ব্যাংক সংস্কারের জন্য করণীয় ঠিক করতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদেরা। উচ্চপর্যায়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলেও কমিশন এখনো গঠিত হয়নি। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ নেই। চাঁদাবাজিও বন্ধ হয়নি।

অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম এমন দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। গত কয়েক বছরে কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে ৮ শতাংশে নেমেছে। কিন্তু রাজস্ব খাতে বড় সংস্কারের কোনো উদ্যোগ এখনো নেয়নি এই সরকার। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অনিয়ম দুর্নীতি খুঁজে বের করতে বড় কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। তবে এ খাতের ‘দায়মুক্তি আইন’ স্থগিত করা হয়েছে।

দুই অর্থনীতিবিদের চোখে মূল্যায়ন

বর্তমান সরকারের প্রথম এক মাসে আর্থিক খাতে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর মূল্যায়নের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের কাছে।

জাহিদ হোসেন বলেন, গত এক মাসে ঘর গোছানো ও আগুন নেভানোয় (দাবিদাওয়া পূরণ) সরকারের বেশি মনোযোগ ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে যে প্রাতিষ্ঠানিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণে সরকার ব্যস্ত ছিল। এসব সংস্থায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, ব্যাংক খাতে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়েছে। মূলত এত দিন অর্থনীতি যে বিকল অবস্থায় ছিল, তা পুনর্গঠন করে স্বাভাবিক অবস্থায় আনার পূর্বশর্ত হিসেবে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করা একটি বড় পদক্ষেপ বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। এ ছাড়া ক্রলিং পেগের মাধ্যমে ডলারের দাম নির্ধারণের নমনীয়তাও প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রে ভালো উদ্যোগ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জাহিদ হোসেন বলেন, এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এতে শিল্প খাতে, বিশেষ তৈরি পোশাক খাতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বাজারঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। চাঁদা নেওয়ার খেলোয়াড়ের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। একটি নির্দলীয় সরকারের আমলে যা হতাশা তৈরি করেছে।

অন্যদিকে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, গত এক মাসে অর্থনীতিতে বড় পদক্ষেপ হলো যোগ্য লোকদের অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টার মতো পদে বসানো হয়েছে। ব্যাংক খাতে কিছু শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এর সুফল পেতে সময় লাগবে।

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা প্রয়োজন।

সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘সরকারকে প্রশাসনব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে কাজ করতে হয়। কিন্তু পুরো প্রশাসনব্যবস্থা এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি বলেই মনে হচ্ছে।’

গত এক মাসে অর্থনীতিতে বড় পদক্ষেপ হলো যোগ্য লোকদের অর্থ উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টার মতো পদে বসানো হয়েছে। ব্যাংক খাতে কিছু শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এর সুফল পেতে সময় লাগবে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.