এতে আরও বলা হয়, সহিংসতার ঘটনাগুলো নারীকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে। সহিংসতার শিকার ৬৫ শতাংশ নারী হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগছেন। তবে ‘অভিযোগ করে লাভ নেই’—এ মনোভাব থেকে ৮৫ শতাংশ নারী প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ করেন না।
গবেষণার জন্য যে জরিপ করা হয়, তাতে ১১ থেকে ১৮ নভেম্বর ৫১৪ অনলাইন ব্যবহারকারী নারী অংশ নেন। এর মধ্যে ৩৫৯ জন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। এ ছাড়া এ বিষয়ে ছয় জেলায় ছয়টি দলগত আলোচনায় গ্রামীণ অঞ্চল থেকে অংশ নিয়েছেন কিশোরী ও নারীরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনলাইন মাধ্যম ব্যবহারে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক নারী সচেতন নন।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন হচ্ছে। এসব নির্যাতনের প্রকাশ ঘটছে নানাভাবে। প্রযুক্তির যুগে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। বিশেষ করে কিশোরী ও ১৮ বছরের নিচের বয়সী মেয়েশিশুরা সহিংসতার বেশি শিকার হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, অনলাইনে সহিংসতা নিরসনে আইনি প্রক্রিয়া জোরদার করার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সহায়তা দরকার।
তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সরকার ও ডিজিটাল সাক্ষরতা কেন্দ্র প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম খান বলেন, সরকার গত বছর ডিজিটাল সাক্ষরতা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। সেখান থেকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল সাক্ষরতা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
১২ ধরনের সহিংসতা
একশনএইডের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইনে নারীর প্রতি ১২ ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে নারীরা অশ্লীল, ক্ষতিকর, যৌনতামূলক ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য পেয়ে থাকেন। ৫৩ শতাংশ নারীকে ইনবক্সে অশ্লীল ছবি পাঠিয়ে যৌন সম্পর্ক করার কথা বলে হয়রানি করা হয়। বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন ১৯ শতাংশ নারী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের নাম ব্যবহার করে ভুয়া আইডি খোলার মাধ্যমে সহিংসতার শিকার হয়েছেন প্রায় ১৮ শতাংশ নারী। ১৬ শতাংশ নারী বলেছেন, সাইবার জগতে তাঁদের কর্মকাণ্ড সব সময় অনুসরণ করা হচ্ছে। সমকামিতার পক্ষে কথা বলায় ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হয়েছেন ১৩ শতাংশ।
এ ছাড়া অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া (পোস্ট), যৌন সহিংসতা করার হুমকি, ফেসবুক লাইভ বা শিক্ষামূলক অধিবেশন চলার সময়ে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য, কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার চাপ, যৌন সহিংসতা ঘটানোর সময় ছবি তুলে ও ভিডিও করে পরে পোস্ট করা এবং নাটক–সিনেমায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলে প্রতারণা করা হয়েছে নারীদের সঙ্গে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন নারীরা, এ হার ৪৭ শতাংশ। মেসেঞ্জারে হারটি ৩৫ শতাংশ। এ ছাড়া ইনস্টাগ্রাম, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবসহ অন্যান্য মাধ্যমেও সহিংসতার মুখে পড়েছেন নারীরা।
প্রতিকার পান না, আত্মবিশ্বাস কমছে
২০২১ ও ২০২২—দুই বছরের জরিপেই একশনএইড দেখেছে, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানানোর হার খুবই কম, মাত্র ১৫ শতাংশ। ওই দুই বছর যাঁরা অভিযোগ করেছেন, তাঁরা অভিযোগ করার জন্য ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম বেশি বেছে নিয়েছেন। এ বছর পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের ফেসবুক পেজে ২০ শতাংশ এবং জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ১৫ শতাংশ অভিযোগ করেছেন। সশরীর গিয়ে অভিযোগ করার আগ্রহ কম।
অভিযোগ না করার কারণ হিসেবে প্রতিকার না পাওয়া; অভিযোগ করেও কাজ হবে না এ ধারণা; অভিযোগ করার পর পরিণতি কী হয়, তা নিয়ে ভয়; সামাজিক সংস্কার এবং অভিযোগকারীকেই উল্টো দোষারোপ করার প্রবণতার কথা বলেছেন নারীরা। যেমন অভিযোগ করেছিলেন, এমন নারীদের ৬৪ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা প্রতিকার পাননি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইনে সহিংসতার শিকার হওয়ার ঘটনা নারীর জীবনে বড় প্রভাব ফেলে। প্রায় ৪২ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তাঁরা অনলাইনে সক্রিয়া থাকা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করার বিষয়ে আর আস্থা পান না।
অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে ১২টি সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর মধ্যে রয়েছে ভুয়া অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করে বাতিল করা এবং সুরক্ষা জোরদার করতে ‘টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন’ বাধ্যতামূলক করা, ভুক্তভোগীরা যেন বিষয়গুলো জনসমক্ষে তুলে ধরার মতো জায়গা পান, সে ব্যবস্থা করা এবং ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিষয়ে সংবাদ প্রকাশে নীতিমালা তৈরি।
সুপারিশের মধ্যে আরও রয়েছে অপরাধ সংঘটনের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া ও বিচারপ্রক্রিয়া প্রকাশ্যে আনা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ করা; অপরাধ সংঘটনকারীদের ইন্টারনেটে প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ; অনলাইনে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, সে বিষয়ে ব্যবহারকারীদের জন্য নীতিমালা তৈরি; ডিজিটাল শিক্ষা বাড়ানো ইত্যাদি।
অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং সাইবার টিনস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাদাত রহমান বলেন, দেশে অনলাইনে হয়রানির কারণে গত দুই বছরে ১১ জন তরুণ-তরুণী আত্মহত্যা করেছেন। কিশোর-কিশোরীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু তারা জানে না কোথায় কীভাবে সহায়তা পেতে হয়। এ কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ এ–সংক্রান্ত অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যেন সহজে সাহায্য পাওয়া যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন মেয়ে নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠক তৃষিয়া নাশতারান, মনোরোগ চিকিৎসক আশিক সেলিম এবং দৈনিক কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক ফাতিমা তুজ জোহরা।