ছোটবেলা থেকেই আরিফ চৌধুরী শুভর বই পড়ার অভ্যাস ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে তিনি একদল তরুণকে নিয়ে জাতীয় পাঠাগার আন্দোলনের (জাপাআ) ব্যানারে গ্রামে বই পড়া কর্মসূচি শুরু করেন। ২০১৩ সালে আরিফ নিজ গ্রাম লক্ষ্মীপুরের কুশাখালী ইউনিয়নের ফরাশগঞ্জে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি স্কুল ও ২০১৫ সালে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন। পাঠাগার উদ্বোধনে ৪০০ গ্রামবাসীকে নিমন্ত্রণ করলেও উপস্থিত ছিলেন মাত্র দু’জন। এরপর প্রভাবশালীরা নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। রাতের আঁধারে ভেঙে ফেলা হতো পাঠাগারের সাইনবোর্ড, বুকশেলফের কাচ, খালে ফেলে দেওয়া হতো বই। মরা মুরগি, মরা ব্যাঙ, মরা সাপ এবং গরুর গোবর, মানুষের মল ছুড়ে মারা হতো রাতের অন্ধকারে। এসবেও আরিফ যখন দমে যাননি তখন তার পাঠাগারে তালা মেরে দেয় বখাটেরা। ভাড়া ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয় স্কুল ও পাঠাগার। কোথাও ঘর না পেয়ে নিজ জমিতে বানানো হয় স্কুল ও পাঠাগার। স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাঁদা না দেওয়ায় সেই ঘর তুলতেও বাধা দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে গুজব ছড়িয়ে পাঠাগারে আগুনে দেওয়ার চেষ্টাও চলে। সব বাধা উপেক্ষা করে আরিফের পাঠাগার ও স্কুল এখন এলাকায় আলো ছড়াচ্ছে।
আরিফের মতো বাধা উপেক্ষা করেও কিছু তরুণ টিকে আছেন, সমাজে আলো ছড়াচ্ছেন। তবে অধিকাংশ তরুণ সমাজে খুব বেশি অবদান রাখতে পারছেন না। গ্রাম্য রাজনীতি, সমাজপতিদের চাপ, পারিবারিক চাপ, মনোসামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক মনোভাব, উপার্জনের ওপর স্বীকৃতি, কল্যাণমূলক কাজে বহুমুখী বাধা, অবমূল্যায়ন, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, শিক্ষক ও ছাত্র অপরাজনীতি, ছাত্র সংসদ না থাকা কিংবা শক্তি না থাকা, জীবনযাত্রার ব্যয়, বেকারত্ব, হতাশা, সামাজিক বৈষম্যসহ নানা বাধার মুখে নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন তরুণরা।
অতীতে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাবের ছড়াছড়ি ছিল। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার ফাঁকে বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। অসহায় দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। আজকের অধিকাংশ তরুণ-তরুণী তাদের পড়াশোনা আর ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার গড়ার কাজে এতটাই বিভোর যে, তাদের আশপাশে তাকানোর ফুরসত কোথায়। এরপরও তারা যতটুকু অবসর সময় পান তা কাটান ইন্টারনেটে। আত্মকেন্দ্রিকতা তাদের গ্রাস করেছে, নিজেকে নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করছেন বেশি।
অদম্য বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের একঝাঁক তরুণ-তরুণী ২০১৩ সালে রাজধানীতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের মূল ধারায় ফেরাতে কাজ শুরু করেন। কিন্তু এ সংগঠনের চার তরুণ-তরুণীর মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ৩৭ দিন জেল ও রিমান্ডের খবর দেশবাসী জানেন। তবুও তারা লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি, অদম্য মনোভাব ঠিকই ধরে রেখেছেন হৃদয়ের গভীরে। আরিফ কিংবা অদম্য বাংলাদেশের মতো অনেক তরুণ বাধাবিপত্তি-প্রতিকূলতা ডিঙাতে পারছেন না। অনেকেই হতাশ হয়ে সে পথ থেকে সরে আসছেন। কেউ কেউ উগ্র রাজনীতির প্রভাব ও অসহযোগিতায় নিজেকে সমাজসেবা থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া অর্থই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে সমাজের বড় অংশের মধ্যে। আগে পরিবার থেকে তরুণদের ওপর নৈতিকতাসম্পন্ন ভালো মানুষ হওয়ার চাপ ছিল। এখন পেশাজীবন ও পরীক্ষায় ভালো করা, বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করা, গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়ার মতো বিষয়ে পরিবার থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে।
নোয়াখালীর উপকূলীয় সুবর্ণচর উপজেলা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এখানে এক সময় বাল্যবিয়ে, যৌতুক, মাদকসহ নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তরুণরা সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে সুবর্ণচরের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে এখন আর তেমন কাউকে সমাজসেবামূলক কাজে দেখা যায় না। কারণ হিসেবে একাধিক তরুণ জানিয়েছেন, একটি ভালো কাজ করতে গেলেই বাধা আসে। অনুষ্ঠান করতে গেলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অতিথি না করলে সব পণ্ড হয়ে যায়। ফলে তরুণরা এখন অন্যায়ের প্রতিবাদ কিংবা সমাজসেবা থেকে নিজেদের অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছেন। সুবর্ণচরে ছাত্রদের একটা বিরাট অংশ এখন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের অনেকেই আবার কলেজের গণ্ডিতেই এখনও পা রাখেনি। দলে দলে মোটরসাইকেল নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ায়। নেতারা তাদের মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন। যতটা রাজনীতির দিকে তাদের আগ্রহ, ঠিক ততটাই অনাগ্রহ পড়াশোনার দিকে। নেতার নামে স্লোগান দিলে টুপাইস পাওয়া যায়, এলাকার টেন্ডার, চাঁদাবাজিতে ভাগ বসানো যায়- এসব কারণে এসব ছাত্র এখন পড়ালেখার চেয়ে রাজনীতির দিকেই বেশি আগ্রহী। তারা কোনো আদর্শ দ্বারা তাড়িত নয়। নগদ প্রাপ্তির আশায় তারা রাজনীতি করে।
দেশের তরুণদের মাঝে যারা রাজনীতি করেন, তাদের অনেকের মধ্যেই প্রতিবাদী মানসিকতা নেই। তারা তাদের সহপাঠী নির্যাতনের শিকার হলে তার পাশে দাঁড়ান না। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতকের ভূমিকা নেন। রাজনৈতিকীকরণের নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে রাজনীতিই হয়ে উঠেছে সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। এ জন্য গ্রামের একজন স্কুলপড়ুয়া ছাত্রও রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর নেতারাও তাকে সানন্দে দলে ভিড়িয়ে দল ভারী করেন।
গত এক মাসে সমকালের পক্ষ থেকে ফেসবুক ও সরাসরি ১০০ তরুণকে নিয়ে জরিপে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি তরুণদের সামাজিক নেতৃত্ব, ক্ষমতায়ন, অবসরে কী করেন- এসব বিষয় নিয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়। জরিপে দেশের দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ১০টি তরুণ সংগঠনের নেতা ও পাঁচটি জেলা শহর এবং গ্রামের তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। তরুণদের জন্য প্রশ্ন ছিল সাতটি। প্রথমে জানতে চাওয়া হয়েছিল, অবসর সময় কীভাবে কাটে? জবাবে ৬০ শতাংশই বলেছেন, তারা অবসরে ইন্টারনেট ব্রাউজ করে সময় কাটান। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার কথা বলেছেন ১০ শতাংশ। ২০ শতাংশ বই পড়েন অবসরে। টিভি দেখে সময় কাটান ১০ শতাংশ তরুণ। দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল, সমাজে কোন ঘাটতি আপনার জীবনযাপন ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় প্রভাব ফেলছে? ৭০ শতাংশ তরুণই বলেছেন মুক্তচিন্তায় বাধা। বাকিরা জবাবদিহির অভাব, নিরাপত্তাহীনতা, অসুস্থ রাজনীতিকে দায়ী করেছেন। সমাজ পরিবর্তনে তরুণরা অবদান রাখতে পারছেন না কেন? জবাবে ৮০ শতাংশ তরুণই পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধা এবং উপার্জনের ওপর স্বীকৃতিকে দায়ী করেছেন। সমাজে তরুণদের নেতৃত্ব দিতে না পারার পেছনে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকেই দায়ী করেছেন ৭৫ শতাংশ তরুণ। এ ছাড়া নেতৃত্বের প্রতি আগ্রহ না থাকার কথাও বলেছেন অনেকে। কোন সমস্যাটি দেশকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে? জবাবে ৫২ শতাংশ তরুণ জানিয়েছেন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযোগের অসমতা দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা। আবার অনেকেই রাষ্ট্রের জবাবদিহির অভাব, আইনের শাসন না থাকা, দারিদ্র্য, মানুষের মাঝে ঐক্য না থাকা ও সমাজে ভয়-ভীতির সংস্কৃতিই বড় সমস্যা মনে করেন। এরপর জানতে চাওয়া হয়েছিল, তরুণদের ক্ষমতায়নে কোন বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে? এতে ৫২ শতাংশ জানিয়েছেন, তরুণদের রাজনীতিসচেতন করে তোলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাকিদের অধিকাংশই মনে করেন, নেতৃত্বের সঠিক মূল্যায়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তরুণদের ক্ষমতায়নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
রাজনীতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল তরুণদের কাছে। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৬০ শতাংশ রাজনীতি নিয়ে তাদের অনাগ্রহের কথা সরাসরি জানিয়েছেন। বাকিদের কাছে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা একেবারেই অপছন্দের। আবার কেউ কেউ রাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনাও করেন না।
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ বলেন, তরুণরা বয়সের কারণে সাধারণত পরোপকারী ও স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। এটাই তারুণ্যের ধর্ম। ফলে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়ায়, সংগঠিত হয়, প্রতিবাদ করে, এমনকি প্রাণ বিসর্জন দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমনটি দেখা যাচ্ছে না। তরুণরা হয়ে পড়েছে সমাজবিচ্ছিন্ন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং ক্যারিয়ারনির্ভর। আদর্শবোধ ও সামাজিক উন্নয়নের চেতনা তাদের মধ্যে কাজ করছে না। কালো টাকা ও অবৈধ অর্থের প্রভাবে সমাজে প্রচলিত দীর্ঘদিনের সামাজিক বন্ধন ভেঙে পড়ছে এবং আদর্শবোধ লুপ্ত হতে চলেছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাও এর জন্য কম দায়ী নয়। শিক্ষা কারিকুলামে মানবিক শিক্ষা কমে যাচ্ছে। জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার পরিবর্তে কেবল দক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী তৈরির শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তরুণদের সামনে কোনো আইডল নেই। এতে তরুণদের মধ্যে সমাজ-সংস্কারের ভাবনা কিংবা সমাজ উন্নয়নমূলক কাজের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতের মানবিক সমাজ গঠনে এটি অ্যালার্মিং।
তরুণদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দেশের সরকারি- বেসরকারি পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিয়েও তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে। একদিকে যেমন তরুণরা গতানুগতিক প্রথা প্রত্যাখ্যান করে বিকল্প হিসেবে প্রতিবাদের প্রথাবিরোধী রাজনীতির দিকে ঝুঁকছেন, অপরদিকে বয়স্করা চাইছেন এসব প্রতিবাদ এড়িয়ে যেতে। এমন দোদুল্যমানতার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। বর্তমানে যেসব নেতৃত্ব কিংবা কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিক আকারে পরিচালিত হয়, তরুণ-তরুণীরা তাতে মোটেও আর আগ্রহী নন। তারা পছন্দ করেন এমন একটি আধুনিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক কাঠামো, যেখানে সবাই ভোগ করবে সমান অধিকার এবং সেইসঙ্গে পালন করবে সমান দায়িত্ব। তারা চান, প্রতিষ্ঠান কিংবা সমাজে তরুণমতকে গুরুত্ব দেওয়া হোক। গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তারুণ্যদীপ্ত নতুন মুখের উপস্থিতি বাড়ুক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, সমাজ সংস্কার, দেশ ও মানবসেবায় তরুণদের ভূমিকা অনন্য, যা আমরা আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ অন্যান্য আন্দোলনে দেখেছি। কিন্তু আজকের তরুণরা সে ধরনের ভূমিকা পালনে অপারগ বা তাদের ভূমিকা পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন তরুণদের দেশ, সমাজ ও মানবতা নিয়ে ভাবার সময় খুবই কম। এর মৌলিক কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র বা সমাজ তরুণদের গঠন করতে ব্যর্থ। আমাদের সমাজ ও রাজনীতি তরুণদের মাদক, সন্ত্রাস ও অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে যেসব তরুণ সমাজের অসঙ্গতি ও সমাজ গঠন নিয়ে কাজ করতে চান রাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করছে। কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। তরুণদের নেতৃত্ব, দেশপ্রেম ও মানবতা বিকাশে সরকারকে সুযোগ করে দিতে হবে। বর্তমান সময়ে সে সুযোগ কম।