মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মারণব্যাধি ক্যানসার ধরা পড়ার পর তাকে জয় করে শতায়ু অর্জন করা একটি অসম্ভবের মতো শোনালেও, চীনের কিংবদন্তি নারী সং মেই-লিং তা বাস্তবে প্রমাণ করেছেন। তিনি নিজেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানান, শৃঙ্খলিত জীবন, সচেতন খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক স্থিতি ছিল তাঁর দীর্ঘায়ুর মূল চাবিকাঠি। ২০০৩ সালে ১০৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা সঙ মেই-লিং আজও স্বাস্থ্য সচেতনতা ও দীর্ঘ জীবনের অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন।


চীনের ইতিহাসে সং মেই-লিং কেবল একজন প্রভাবশালী নারী নন, বরং দীর্ঘায়ুর এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত। তিনি ছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাই-শেকের স্ত্রী, সমাজসংস্কারক, এবং ২০ শতকের চীনের অন্যতম আলোচিত ব্যক্তিত্ব। মাত্র ৪০ বছর বয়সে ক্যানসারে আক্রান্ত হলেও সং মেই-লিং এই রোগকে জয় করে জীবনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, শৃঙ্খলিত জীবন ও সচেতন খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে ১০৬ বছর পর্যন্ত প্রাণবন্ত ছিলেন। তাঁর এই দীর্ঘায়ুর রহস্য শুধু দৈহিক স্বাস্থ্য নয়, বরং মানসিক স্থিতি, সৃজনশীলতা এবং প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাসের মেলবন্ধনে নিহিত ছিল। চলুন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসি।
শৃঙ্খলায় গড়া স্বাস্থ্যকর জীবন
সং মেই-লিংয়ের প্রতিদিন ছিল এক অনুশাসনের প্রতিচ্ছবি। তিনি কখনো রাত জাগতেন না, বরং রাত ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতেন এবং সকাল ৯টায় জেগে উঠতেন। পর্যাপ্ত ঘুমকে তিনি মনে করতেন শরীর ও মনের ভারসাম্যের মূলভিত্তি। তিনি দিনের শুরুটা করতেন এক গ্লাস লেবুর পানি দিয়ে, যা আমাদের শরীরের টক্সিন দূর করে ও হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে।

তিনি বিশ্বাস করতেন, “দিনের শুরু যেমন, দিনের শক্তিও তেমন”।তাই সকালে প্রশান্ত মন আর হালকা শরীর রাখাই ছিল তাঁর প্রথম অগ্রাধিকার। চিত্রাঙ্কন, বই পড়া, সংগীত শোনা কিংবা ধ্যান,এই সব সৃজনশীল কাজ ছিল তাঁর মানসিক প্রশান্তির মাধ্যম। তবে তিনি দিনে দুই ঘণ্টার বেশি এসব কাজে সময় দিতেন না, কারণ তিনি মনে করতেন,অতিরিক্ত মানসিক শ্রমও শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
ফল ও সবজিতে সচেতন খাদ্যাভ্যাস
খাবারের ক্ষেত্রে সং ছিলেন অত্যন্ত বেছে খাওয়া একজন মানুষ। তিনি অতিরিক্ত ঝাল, তেল বা সংরক্ষিত খাবার এড়িয়ে চলতেন। তাঁর প্রিয় ফল ছিল লিচু, আনারস ও কিউই।যেগুলো ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও পানিশূন্যতা প্রতিরোধে বেশ কার্যকরী।তবে সবজির মধ্যে পালং শাক ও সেলারি ছিল তাঁর দৈনন্দিন খাদ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।


সেলেরি: রক্তপরিশোধন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের গোপন অস্ত্র
সেলেরি নামের সবজি ছিল তাঁর খাদ্যতালিকার নিয়মিত উপকরণ। প্রাচীন চীনা চিকিৎসা মতে, সেলেরি যকৃৎ পরিষ্কার রাখে, শরীর ঠান্ডা করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এতে রয়েছে প্রোটিন, বি-ভিটামিন, ক্যারোটিন, ও আঁশ,যা আমাদের শরীরে রক্ত পরিশুদ্ধ করে, হৃদরোগ প্রতিরোধ করে এবং অতিরিক্ত চর্বি দূর করে।এর পাতা শরীরের জন্য বিশেষ উপকারী, কারণ এতে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয় ও মানসিক চাপ কমে।
পালং শাক: শক্তি, সৌন্দর্য ও তারুণ্যের রক্ষক
পালং শাক ছিল তাঁর দীর্ঘ জীবনের অন্যতম গোপন রহস্য। এতে থাকা ভিটামিন বি২, লোহা, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস আমাদের শরীরের জন্য শক্তি সরবরাহ করে এবং বার্ধক্য বিলম্বিত করে।চীনা চিকিৎসাশাস্ত্র “আউটলাইন অব দ্য মেটেরিয়া মেডিকা”-তে বলা হয়েছে, পালং শাক রক্ত পরিষ্কার রাখে, হজমে সাহায্য করে, গরমে শরীর ঠান্ডা রাখে এবং সেই সাথে এটি আমাদের ত্বক উজ্জ্বল করে। সং নিয়মিত টমেটো ও গাজরের সঙ্গে এই পালং শাক খেতেন।এই মিশ্রণ ফুসফুস ক্যানসার প্রতিরোধে বিশেষ কার্যকর বলে গবেষণায় দেখা গেছে।


মানসিক প্রশান্তি ও ইতিবাচকতার শক্তি
শুধু খাবার নয়, মানসিক প্রশান্তিকেও তিনি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করতেন। তিনি প্রতিদিন কিছু সময় ধ্যানে কাটাতেন, নিজেকে প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত রাখতেন।তাঁর প্রিয় উক্তি ছিল,“মন যদি শান্ত থাকে, শরীর নিজেই সুস্থ হয়ে ওঠে।” তাঁর এই অভ্যাসই তাঁকে ক্যানসারের মতো মারণব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানসিকভাবে শক্ত করে তুলেছিল।
সং মেই-লিংয়ের জীবন আমাদের শেখায়, দীর্ঘায়ু এবং সুস্থতা কোনো জাদুকরী রহস্য নয়, বরং শৃঙ্খলিত জীবন, সচেতন খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক প্রশান্তির ফল।

প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাস যেমন পর্যাপ্ত ঘুম, লেবুর পানি দিয়ে সকাল শুরু করা, সেলারি ও পালং শাকের মতো পুষ্টিকর সবজি খাওয়া এবং ধ্যানের মতো মানসিক প্রশান্তির অভ্যাস সব মিলেই তৈরি হয় এক স্বাস্থ্যকর জীবনধারা। তাঁর গল্প আজও প্রমাণ করে, সহজ, সাদামাটা জীবন ও প্রাকৃতিক খাদ্যই পারে আমাদের দীর্ঘায়ু, প্রাণবন্ততা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উপহার দিতে।
তথ্যসূত্র: দ্যা বাস্টেড নিউজ
ছবি: ইন্সটাগ্রাম, পেকজেলস ও উইকিপিডিয়া
















