১৪ পদেই জয়ী আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা

0
143
ছবি: সংগৃহীত

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছেন সরকার সমর্থকরা। গতকাল বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঘোষিত ফলাফলে ১৪ পদের সবক’টিতে জয় পেয়েছেন সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা। অবশ্য আগেই বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের নীল প্যানেল এ নির্বাচন বর্জন করে।

বিজয়ীরা হলেন সভাপতি পদে বর্তমান সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মোমতাজউদ্দিন ফকির, সাধারণ সম্পাদক পদে আব্দুন নুর দুলাল, সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী আজম ও জেসমিন সুলতানা, কোষাধ্যক্ষ মাসুদ আলম চৌধুরী, সহসম্পাদক নুরে আলম উজ্জ্বল ও হারুনুর রশিদ, কার্যনির্বাহী সদস্য পদে সাফায়েত হোসেন সজীব, মহিউদ্দিন রুদ্র, শফিক রায়হান শাওন, সুভাষ চন্দ্র দাস, নাজমুল হোসেন স্বপন, দেলোয়ার হোসেন ও মনিরুজ্জামান রানা।

এর আগে দিনভর উত্তেজনা, ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি ও পাল্টাপাল্টি মিছিল এবং ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন শেষ হয়। এরপর রাতে শাহবাগ থানায় বিএনপিপন্থি ৩৫০ আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ।

অবশ্য ভোট শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা আগেও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা মুখোমুখি অবস্থান নেন। এ সময় তাঁরা দফায় দফায় মিছিল ও স্লোগান দেন। দুপুর ১২টা থেকে পৌনে ১টা পর্যন্ত দু’পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, হাতাহাতি ও ধাক্কাধাক্কি হয়। এসবের প্রভাবে নির্বাচনে ভোট পড়েছে অর্ধেকেরও কম। ৮ হাজার ৬০২ ভোটারের মধ্যে দুই দিনে ভোট দিয়েছেন ৪ হাজার ১৩৭ জন।

এদিকে, উচ্চ আদালতে পুলিশের কয়েক সদস্যের বাড়াবাড়ির ঘটনা ভালোভাবে নেননি বাহিনীর নীতিনির্ধারকরা। অতি উৎসাহী হয়ে কেন পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়েছে– তা তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনায় জড়িত সদস্যদের চিহ্নিত করতে ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। এরই মধ্যে দুই কনস্টেবলকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাঁরা ঘটনার সময় মারমুখী আচরণ করেন। এ ছাড়া ল রিপোর্টার্স ফোরামের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের হেনস্তার জন্য রমনা বিভাগের এডিসি হারুন অর রশিদকে দায়ী করা হয়েছে।

ধীরে ধীরে বাড়ে উত্তেজনা : নির্বাচনের দ্বিতীয় দিন গতকাল সকাল ১০টায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের ভোটকেন্দ্রে দুই দলের আইনজীবীরা জড়ো হন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে তাঁরা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশ সতর্ক অবস্থান নেয়। ভোটকেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের দেখা গেলেও বিএনপিপন্থিদের ভোট দিতে দেখা যায়নি।

যা বললেন বিশিষ্ট আইনজীবীরা : নির্বাচন ঘিরে এ ধরনের সহিংস ঘটনা ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ও ‘অনভিপ্রেত’ বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনি  বলেন, সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এখানকার আইনজীবীরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যা ঘটে গেল, তাতে ঐতিহ্যবাহী সুপ্রিম কোর্ট বারের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। এটা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা। সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনে ভবিষ্যতে যেন এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তার জন্য সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে বলে আশা প্রকাশ করেন বারের সাবেক এ সভাপতি।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, নির্বাচন নিয়ে আমাদের ঐতিহ্য ও গণতান্ত্রিক সহনশীলতা, আইনের শাসনের প্রতি জবাবদিহিতাকে কবর রচনা করতে দেখলাম। সুপ্রিম কোর্টের সোনালি অতীত কবরের ভেতর। তিনি বলেন, এরশাদের সামরিক শাসনামলেও সুপ্রিম কোর্ট বারে পুলিশ পাহারায় নির্বাচন করতে দেখিনি, এবার যা দেখলাম। আইনজীবী ও সাংবাদিকদের লাঠিপেটা করা হলো। এগুলো কীসের আলামত! দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বারে পুলিশ দিয়ে নির্বাচন করতে হবে– একজন আইনজীবী হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, ইদানীং সুপ্রিম কোর্ট বারসহ বিভিন্ন বারের নির্বাচন অতীতের মতো শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যময় পরিবেশে হচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে আমাদের ক্রমাগতভাবে ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্র। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে একদিকে সরকার ক্রমাগত শক্তিশালী হয়, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান দুর্বল হতে থাকে। এই নির্বাচনে যাঁরাই জয়ী হোন না কেন, তাঁদের কমিটি আগের মতো শক্তিশালী ও শ্রদ্ধাশীল হবে না। অতএব, সুপ্রিম কোর্ট বার একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত হল।

বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের দৌড়ঝাঁপ : নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুলিশি হামলাসহ দু’দিনের নানা ঘটনা নিয়ে গতকাল সারাদিন বিভিন্ন তৎপরতা চালান বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আট সদস্যের আপিল বিভাগে ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন তাঁরা।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বারের সাবেক সভাপতি এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, বুধবার আদালত প্রাঙ্গণে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। আজও (গতকাল) রুমে তালা লাগানো আছে। অনেকের রুমের চারপাশে পুলিশ। বাইরে থেকে এ ঘটনার পেছনে কেউ আছে কিনা, তা দেখতে হবে। এই অঙ্গনে এটা কি অনুমোদিত? পুলিশকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, তারা সমিতির সিনিয়র সদস্যদেরও নির্যাতন করেছে। আমরা আপনার কাছে এর প্রতিকার চাচ্ছি।

বিএনপি প্যানেল থেকে সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস বলেন, আপনারা দেশের বিচার বিভাগের অভিভাবক। তাই প্রত্যেকের ব্যথা, কষ্ট অভিভাবক হিসেবে অবহিত করা উচিত। সমিতির নির্বাচন হয় সবসময় উৎসবমুখর। তবে এবার অবস্থা উল্টো, আমিও আমার রুমে ঢুকতে পারিনি। রুমের বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। শত শত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অনেক আইনজীবী আহত হয়েছেন। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের কী অপরাধ? আমি একজন প্রার্থী হয়ে কেন ভোটকেন্দ্রে থাকতে পারব না?

সমিতির সভাপতি প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। তিনশ-চারশ পুলিশ ভোটকেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। আইনজীবী এবং সাংবাদিকদের পিটিয়ে আহত করা হয়েছে।

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আমার কোনো করণীয় থাকলে করব। প্রয়োজনে অ্যাটর্নি জেনারেলকেও ডাকব।

প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই : দুপুরে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি বেসরকারি সংগঠন। এখানে প্রধান বিচারপতির কিছু করার নেই। প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির সঙ্গে দেখা করার পর দুপুরে সাংবাদিকদের এ সব কথা বলেন তিনি। অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, প্রধান বিচারপতি বলেছেন, বারের সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সবাই মিলে পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার চেষ্টা করেন।

সাংবাদিকদের মারধরে ডিএমপি কমিশনারের দুঃখ প্রকাশ : সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বুধবার সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান হারুর অর রশীদ। গতকাল সকালে সুপ্রিম কোর্টে অবস্থিত ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) কার্যালয়ে এসে নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। পরে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে ডিবি প্রধান বলেন, গতকালের ঘটনায় তারা দুঃখিত। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা পুরোপুরি অনিচ্ছাকৃত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য পুলিশ সচেষ্ট থাকবে।

পরে মোবাইল ফোনে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক এলআরএফ সভাপতি আশুতোষ সরকারের সঙ্গে কথা বলে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সে বিষয়টি দেখা হবে বলে জানান তিনি।
২২ আইনজীবীর আগাম জামিন : নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যালট পেপার ছিনতাই, হট্টগোলের অভিযোগে শাহবাগ থানার দুই মামলায় বিএনপিপন্থি ২২ আইনজীবীকে আগাম জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। পৃথক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের নেতৃত্বে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ গতকাল তাঁদের আগাম জামিন মঞ্জুর করেন। তবে মারধর ও ভাঙচুরের ঘটনায় শাহবাগ থানায় করা মামলায় সালাউদ্দিন রিগ্যান নামে একজন আইনজীবীকে এক দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।

৩৫০ জনের নামে মামলা : নির্বাচন ঘিরে পুলিশের ওপর হামলা ও ভোটকেন্দ্রে ভাঙচুরের অভিযোগে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের বিরুদ্ধে গতকাল রাতে শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। এতে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, মনজুরুল আলম সুজনসহ ১৪ জনের নাম ও অচেনা ৩৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। বুধবার রাতে একই থানায় দুটি মামলা হয়। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত তিনটি মামলা হলো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.