বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন একপর্যায়ে রূপ নেয় সরকার পদত্যাগের এক দফায়। পুলিশবাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে একপর্যায়ে সারা দেশে সেনা মোতায়েন করে সরকার। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি, দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর আগে ২ আগস্ট এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। ওই দিন এক বৈঠকে তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। খবর ভারতীয় সাপ্তাহিক সংবাদ সাময়িকী দ্য উইকের।
প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য ওই বৈঠক ডেকেছিলেন সেনাপ্রধান। সেখানে তিনি সেনা কর্মকর্তাদের ক্ষোভ প্রশমনে কিছু যুক্তি তুলে ধরেন। ওয়াকার-উজ-জামান তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর হলে বাংলাদেশ কেনিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলোর মতো হয়ে যেতে পারে।
এ সময় তিনি কর্মকর্তাদের সংযত থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ১৯৭০ সালের পর আমাদের দেশে এমন গণবিক্ষোভ আর কখনো ঘটেনি। এটি একটি ব্যতিক্রম ঘটনা। আমাদের সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।
তবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যে আশ্বস্ত হননি কর্মকর্তারা। তরুণ কর্মকর্তাদের ক্ষোভ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বৈঠকটি শেষ হয়। এর মধ্য দিয়ে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবি মানতে বাধ্য হন।
বৈঠকের তিন দিন পর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা একটি সামরিক হেলিকপ্টারে চড়তে বাধ্য হন। ওই হেলিকপ্টার তাকে ভারতীয় সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলায় নিয়ে যায়। সেখানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি সি১৩০ পরিবহন উড়োজাহাজ অপেক্ষমাণ ছিল, সেটা তাকে দিল্লির কাছে হিন্দন বিমানঘাঁটিতে নিয়ে যায়।
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অবস্থা ছিল অস্বস্তিকর। কারণ, তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তা ছাড়া বৈবাহিক সূত্রে তিনি শেখ হাসিনার আত্মীয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিষয়টি সম্ভবত জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও সতর্ক করে তুলেছিল। বিশৃঙ্খলার মধ্যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড মোকাবিলা ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সেনা মোতায়েনকে যৌক্তিক হিসেবে তুলে ধরতে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। তারা ১ হাজার ৭১৯টি গুলি ছুড়েছে, ১৪ হাজার ফাঁকা গুলি ছুড়েছে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস জনতার মুখোমুখি হয়ে ৩১টি উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে।
মতবিনিময়ে সেনাপ্রধানের পদক্ষেপের বৈধতা নিয়ে তদন্তের আহ্বান আসে। তরুণ মেজর মো. আলী হায়দার ভূঁইয়া সেনা মোতায়েনকালে সেনাবাহিনী যে ভূমিকা রেখেছে, তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি পবিত্র কোরআন থেকে উদ্ধৃত করেন, তিনি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আল্লাহর করুণা ভিক্ষা করেন এবং এতে যুক্ত না হওয়ার কথা বলেন। একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শুধু বলেন, ‘আমিন’।
নারী কর্মকর্তা মেজর হাজেরা জাহান এই ঘটনায় শিশুদের প্রাণহানি ও এর ন্যায্য বিচার হওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের অসন্তোষ বাড়তে থাকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সেনাপ্রধান তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির এক কর্মকর্তা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কয়েকজন কর্মকর্তার ‘অগ্রহণযোগ্য’ কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন। জবাবে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, পরিস্থিতি ঠিক হলে এগুলো দেখা হবে।
সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের সমর্থন কমে যাওয়ার কথা তুলে ধরে সেনাসদস্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন ৫ এয়ার ডিফেন্স রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব। চট্টগ্রামের আরেক কর্মকর্তা আহত শিক্ষার্থীদের সহায়তার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করার পরামর্শ দেন।
সব শেষে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান যে সামাজিক চাপ ও হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন, তা তুলে ধরেন এবং নিজের হতাশা প্রকাশে আইয়ুব বাচ্চুর একটি গানের কথা তুলে ধরেন।