হাসপাতালে যেভাবে মারা গেলেন একজন সুস্থ মানুষ

0
160
ডাক্তার

অপচিকিৎসা ও অবহেলায় মো. জাকির হোসেন খান নামে এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তাঁর স্বজনরা। তাঁদের দাবি, সুস্থ জাকিরের হার্টে কোনো প্রয়োজন ছাড়াই রিং (স্টেন্ট) পরানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, পরবর্তী সময়ে রোগীর জটিলতা দেখা দিলেও চিকিৎসা মেলেনি। এমন মৃত্যুর জন্য বিআরবি হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শেখর কুমার মণ্ডল ও ল্যাবএইডের অধ্যাপক ডা. গোলাম আজমকে দায়ী করেছেন রোগীর স্বজনরা। রাজধানীর কলাবাগান থানায় এ নিয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন রোগীর স্ত্রী নূরুননাহার।

গত ১৫ মার্চ গ্রিনলাইফ হাসপাতালে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এর পর ২৪ মার্চ ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রী নূরুননাহার এ অভিযোগ দাখিল করেন। একই সঙ্গে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে। অপচিকিৎসায় জড়িত দু’জনের চিকিৎসা সনদ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন রোগীর স্বজনরা। তবে এখনও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ধানমন্ডির বাসিন্দা জাকির হোসেন খান গত ১২ মার্চ সকালবেলা বুকে ব্যথা নিয়ে গ্রিনলাইফ হাসপাতালে ভর্তি হন। ইসিজিসহ কয়েকটি পরীক্ষা করে হার্টে কোনো সমস্যা নেই বলে জানান হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাশেদুল হাসান কনক। প্রাথমিক চিকিৎসায় বুকে ব্যথা কমে যাওয়ায় ব্যবস্থাপত্রে তিনটি গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ লিখে ছাড়পত্র দিয়ে দেন।

সন্ধ্যায় নিজ উদ্যোগে রোগী রাজধানীর পান্থপথে অবস্থিত বিআরবি হাসপাতালে গ্যাস্ট্রোলজি বিশেষজ্ঞ মো. মাহবুবুল আলম প্রিন্সকে দেখান। তিনি ডায়াবেটিস ও বুকের ব্যথা শুনে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বলেন। ওই হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট চিকিৎসক ডা. শেখর কুমার মণ্ডলের কাছে যান জাকির।

হার্টের রিং বাণিজ্য

তিনি সঙ্গে সঙ্গে ইসিজি ও ইকো করানোর পরামর্শ দেন। দেড় ঘণ্টা পর রিপোর্টগুলো দেখে এ চিকিৎসক বলেন, আপনি এখনও বেঁচে আছেন কীভাবে, আপনার হার্টে দুটি ১০০ ভাগ ব্লক পাওয়া গেছে। দ্রুত রিং পরাতে হবে। আস্তে আস্তে আপনার হার্টের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এমন কথা শুনে রোগী নিজে ডাক্তারকে বলেন, আমরা ইউনাইটেড হাসপাতালে যেতে চাই। তখন ডা. শেখর বলেন, এত সময় আপনার হাতে নেই। একমাত্র গ্রিনলাইফের ক্যাথল্যাব প্রস্তুত রয়েছে। আমি নিজেই আপনার হার্টে রিং পরাব। রোগীর স্বজনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়া রাত ৯টার দিকে ডা. শেখর কুমার মণ্ডল ল্যাবএইডের চিকিৎসক অধ্যাপক গোলাম আজমকে সঙ্গে নিয়ে হার্টে রিং পরান। তবে চিকিৎসকরা কোনো রকম পূর্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই রোগীর হার্টে এ রিং পরিয়েছেন। রিং পরানোর সময় রোগীর রক্তে সুগারের মাত্রা ছিল ১৭।

জাকির হোসেনের চিকিৎসা নেওয়ার রিপোর্ট ও ব্যবস্থাপত্র দেখে জানা যায়, তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন, নিয়মিত ইনসুলিন গ্রহণ করতেন। রিং পরানোর পর ১২ ঘণ্টার মধ্যে ডায়াবেটিসের কোনো ইনসুলিন দেওয়া হয়নি। পরিবারের অভিযোগ, জাকিরের ডায়াবেটিসের ইনসুলিন বন্ধের বিষয়ে তাঁর স্বজনের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি।

স্ত্রী নূরুননাহার বলেন, সে সময় অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসক শেখর মণ্ডল। তিনি বলেন, সুস্থভাবে রিং পরানো হলেও রোগীর কিটোনবডি পজেটিভ। এ অবস্থায় রোগীকে নূরুননাহার অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করতে চাইলে চিকিৎসক শেখর মণ্ডল অসম্মতি জানান এবং বলেন তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখতে। অন্যদিকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ইনচার্জ ডা. মো. আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, রোগীর ফুসফুসে নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য অঙ্গের কার্যকারিতা হারিয়েছে, চিকিৎসকের পরামর্শে আইসিইউতে নেওয়া হয়।

১৩ মার্চ রাত ১২টা ৩৬ মিনিটে আইসিইউ থেকে জানানো হয়, রোগীর অবস্থা আরও অবনতি হয়েছে, এখনই লাইফ সাপোর্ট দেওয়া জরুরি। রোগীর শরীরে তখন প্রচুর পরিমাণে পানি জমে শরীর ফুলে গেছে। লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার আগে হার্ট ফেইলিওর হওয়ায় ফুসফুসে রক্ত ও পানি জমে এবং ক্রমান্বয়ে রোগীর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। একই সঙ্গে কিডনি জটিলতার কারণে রোগীর সিআরআরটি ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়। তবে সিআরআরটি ডায়ালাইসিস মেশিন পাওয়া গেলেও মেশিনের কিট ও লিকুইড পাওয়া যায়নি। গ্রিনলাইফ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ব্যবস্থা না থাকায় রোগীর শরীর ও ফুসফুসে অতিরিক্ত পানি চলে এলে ১৫ মার্চ রাতে জাকিরের মৃত্যু হয়। পরে চিকিৎসক শেখর মণ্ডল কিছু না বলে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান।

রোগীর স্ত্রী নূরুননাহার বলেন, ১৬ মার্চ সকাল ১১টার দিকে মরদেহ গ্রহণ করতে হাসপাতালে যাই। চিকিৎসার অব্যবস্থাপনার বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাই। এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের বিল ৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা দাবি ছেড়ে দিয়ে লাশ নিয়ে যেতে বলে এবং হাসপাতালের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে বিষয়টি বাইরে আলাপ-আলোচনা না করতে আমাদের অনুরোধ করে। পাশাপাশি ঘটনার দায় স্বীকার করে গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আমাদের লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়।

নূরুননাহারের অভিযোগ, শুধু কমিশন বাণিজ্যের জন্য রোগীর হার্টে ১ লাখ ৮২ হাজার টাকার অপ্রয়োজনীয় রিং বসানো হয়েছে। এমনকি এনজিওগ্রামের রিপোর্ট একাধিক চিকিৎসককে দেখালে তাঁরা বলেন, এ ব্লকে রিং পরানোর প্রয়োজন ছিল না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন রোগীকে রিং পরালে সেই চিকিৎসক কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমিশন পেয়ে থাকেন।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. শেখর কুমার মণ্ডল বলেন, সকালে গ্রিনলাইফ হাসপাতালে ডায়াবেটিস ও রক্তে সুগারের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। তাই জরুরি অবস্থায় রাতে আর পরীক্ষা করা হয়নি। রক্তে সুগারের মাত্রা ১৭ আসার পরও কেন রিং পরানো হলো– এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রোগীর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ থাকায় হার্টে রিং পরানোটা জরুরি ছিল।

আট ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট পরিবর্তন হলো কীভাবে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিআরবি হাসপাতালে ইসিজি ও এনজিওগ্রামে হার্টে ব্লক ধরা পড়ে। এর পর অধ্যাপক ডা. গোলাম আজম স্যারের সঙ্গে আলোচনা করেই রিং পরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অনেক সময় দুই ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্টের ফল পরিবর্তন হতে পারে। তিনি দাবি করেন, সব মেডিকেল প্রটোকল অনুসরণ করে তিনি চিকিৎসা করেছেন।

অধ্যাপক ডা. গোলাম আজম বলেন, আমি ল্যাবএইড হাসপাতালে চেম্বার করি। তবে মাঝে মাঝে বিভিন্ন হাসপাতালে রিং পরাতে যাই। ডা. শেখর আমাকে রিং পরাতে ডেকেছিলেন। আমি রোগীর বিষয়ে বিস্তারিত জানতাম না।

রিং পরানোর আগে রুটিন টেস্টগুলো করানো হলো না কেন– জানতে চাইলে তিনি বলেন, জরুরি চিকিৎসা নিশ্চিতের কথা বিবেচনা করে এসব টেস্ট করানো হয়নি। অনেক দেশেই এমন টেস্ট ছাড়াই জরুরি অবস্থায় রোগীর দ্রুত রিং পরানো হয়।

এ বিষয়ে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাইনূল আহসান বলেন, ঘটনার পরপর ওই দুই চিকিৎসককে আমার হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়া বন্ধ করে দেই। রোগীকেs ডা. শেখর কুমার মণ্ডলের অধীনে ভর্তি করা হয়। তিনি তাঁর বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি রোগীর স্বজনকে বলছি, আপনারা চাইলে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা ও বিএমডিসিতে অভিযোগ করতে পারেন।

তবিবুর রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.