ইসরায়েলের গর্ব করার মতো নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ধসিয়ে দিয়ে গত শনিবার সেখানে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ফিলিস্তিনের সংগঠন হামাস। সম্ভাব্য কঠোর পরিণতি জানা সত্ত্বেও এ হামলা চালিয়ে শুধু ইসরায়েল নয়, পুরো বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছেন হামাসের সদস্যরা। ইসরায়েল বলছে, হামাসের এ হামলা অনেকটা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের জোড়া ভবনে আল–কায়েদার হামলার মতো।
হামলার পর অনেকরই প্রশ্ন—সীমিত সক্ষমতা নিয়ে এত বড় পরিসরে হামলা কীভাবে চালাল হামাস? সংগঠনটির শক্তিমত্তা আসলে কোথায়? এ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বা মাস্টারমাইন্ড আসলে কে?
শনিবারের হামলাকে আল–আকসার বন্যা বা আল–আকসা ফ্লাড বলে উল্লেখ করেছে হামাস। ইসরায়েলের ভূখণ্ডে মাত্র ২০ মিনিটে হামাসের হাজার পাঁচেক রকেট নিক্ষেপের পরপরই একটি অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে। এতে কথা বলতে শোনা যায় হামাসের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফকে। ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। দেইফ বলেন, এ হামলার মধ্য দিয়ে জেরুজালেমে আল–আকসা প্রাঙ্গণে ইসরায়েলের অভিযানের প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে।
মক্কা ও মদিনার পর আল–আকসা মুসলিমদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র জায়গা। ২০২১ সালের মে মাসে আল–আকসায় অভিযান চালায় ইসরায়েল। হামাসের সূত্র জানায়, ওই হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। তখন থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া পরিকল্পনা করছিলেন দেইফ।
হামাসের ওই সূত্র জানায়, পবিত্র রমজান মাসে টানা ১১ দিনের লড়াইয়ে আল–আকসায় প্রাঙ্গণে তরুণ–বয়স্কদের হত্যা করা হয়েছিল। ওই ঘটনা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সঞ্চার করে। প্রতিশোধের আগুন উসকে দেয়। দুই বছরের বেশি সময় পর এসে ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিয়েছে হামাস।
১৯৭৩ সালে আরব–ইসরায়েল যুদ্ধে পর আর কখনোই ইহুদি রাষ্ট্রটিকে নিজেদের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে এতটা চ্যালেঞ্জ ও উদ্বেগের মুখে পড়তে হয়নি। শনিবারের হামলায় প্রাণ গেছে ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলির।
শুরুতে কিছুটা হকচকিত হয়ে পড়লেও দ্রুত ফিলিস্তিনের গাজায় পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। দেশটি আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে হামাসের বিরুদ্ধে। সেই থেকে গাজায় মুহুর্মুহু হামলা চালানো হচ্ছে। এসব হামলায় গাজায় ধসে পড়ছে একের পর এক স্থাপনা। দেখা দিয়েছে মানবিক সংকট। প্রাণ গেছে নারী ও শিশুসহ ৯০০–এর বেশি মানুষের। যুদ্ধ শুরুর পর গাজাকে কার্যত অবরোধ করে রাখা হয়েছে।
দেইফের অডিও বার্তা
হামাসের কমান্ডার দেইফকে হত্যা করতে সাতবার চেষ্টা চালিয়েছে ইসরায়েল। সর্বশেষ চেষ্টাটি ছিল ২০২১ সালে। তবে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। দেইফ সচরাচর প্রকাশ্যে আসেন না, কথা বলেন না। গত শনিবার হামাস নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেলে যখন ঘোষণা দেওয়া হয় যে মোহাম্মদ দেইফ কথা বলবেন; তখন ফিলিস্তিনিরা বুঝে গিয়েছিলেন, নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটেছে।
রেকর্ড করা বার্তায় জাতির উদ্দেশে দেইফ বলেন, ‘আজ আল–আকসার আবেগের দিন, আপনাদের (হামাস যোদ্ধা) আবেগের দিন। আজ অপরাধীদের বুঝিয়ে দেওয়ার দিন, তোমাদের সময় শেষ হয়ে গেছে।’
মোহাম্মদ দেইফ একজন রহস্যে ঘেরা মানুষ। আগেই বলা হয়েছে, তিনি প্রকাশ্যে এসে কথা বলতে পছন্দ করেন না। সংবাদমাধ্যমে তাঁর তিনটি ছবি ঘুরেফিরে আসে। দেইফের বয়স যখন বিশের কোঠায়—একটি ছবি তখনকার। অন্য দুটি ছবির মধ্যে একটিতে দেইফকে মাস্ক পরে থাকতে এবং অন্যটিতে তাঁর ছায়া দেখা যায়। তিনি কোথায় বসবাস করেন, সেটাও স্পষ্ট নয়।
ইসরায়েলিদের বিশ্বাস, গত শনিবারের আকস্মিক ও ব্যাপক হামলার মূল পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নকারী মোহাম্মদ দেইফ।
‘মাস্টারমাইন্ড’ একজনই
মোহাম্মদ দেইফ হামাসের সামরিক শাখা আল–কাসেম ব্রিগেডের কমান্ডার। হামাস–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শনিবারের হামলার পেছনে দেইফ ও ইয়াহিয়া সিনওয়ার একসঙ্গে পরিকল্পনা করেছেন। সিনওয়ার গাজায় হামাসের নেতা। তবে এটা ঠিক যে হামলার পেছনে দুটি মস্তিষ্ক কাজ করেছে। কিন্তু মূল ‘হোতা’ বা মাস্টারমাইন্ড একজনই। সেটা দেইফ।
এ জন্য পাল্টা আক্রমণ শুরু করার পর দেইফের পরিবারের ওপর চরম প্রতিশোধ নিয়েছে ইসরায়েল। গাজায় বিমান হামলায় দেইফের বাবা, এক ভাই এবং তাঁর পরিবারের আরও দুই সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। হামাস–সংশ্লিষ্ট সূত্রটি হামলা ও নিহত হওয়ার এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্রটি আরও বলছে, ইসরায়েলের শত্রু এবং হামাসের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সহায়তাকারী ইরান ব্যাপক পরিসরের এ হামলার খবর আগে থেকে জানত। কিন্তু হামাসের পক্ষ থেকে তেহরানকে কখনোই হামলার সময়–স্থান সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি। আর এ কারণে আকস্মিক এ হামলার পরিধি ও ভয়াবহতা ইসরায়েলসহ সবাইকে হতবাক করে দেয়।
প্রস্তুতি দুই বছরের
ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামাসের হামলার পর অভিযোগের আঙুল ওঠে ইরানের দিকে। অনেকেই বলতে শুরু করেন, এত বড় হামলা চালানোর সক্ষমতা হামাসের নেই। এর পেছনে অবশ্যই ইরান জড়িত। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ইসরায়েলে হামলার পেছনে ইরান জড়িত নয়। এমনকি ওয়াশিংটনের একটি সূত্র জানিয়েছে, ইরানের জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ তাদের হাতেও নেই।
এ থেকে এটাই স্পষ্ট হয়, সম্ভাব্য হামলার খবর পুরোপুরি গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন মোহাম্মদ দেইফ। হামাসের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান আরি বারাকা জানান, দুই বছর ধরে এ হামলার পরিকল্পনা করা ও প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। তাই বলা যায়, বছর দুয়েক এত বড় একটি পরিকল্পনার খবর গোপন রাখতে শতভাগ সফল হয়েছেন দেইফ।
সংবাদমাধ্যমে সম্প্রচারিত অডিও বার্তায় শান্ত কণ্ঠে দেইফ বলেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বন্ধ করতে হবে ইসরায়েলকে। সেই সঙ্গে আটক ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দিতে হবে। নির্যাতন এবং ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করা বন্ধ করতে হবে। মোটাদাগে ইসরায়েলের কাছে এটাই হামাসের চাওয়া।
জন্ম শরণার্থীশিবিরে
মোহাম্মদ দেইফের জন্ম ১৯৬৫ সালে, খান ইউনিস শরণার্থীশিবিরে। ১৯৪৮ সালের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের পর এই শরণার্থীশিবির প্রতিষ্ঠিত হয়। দেইফের নাম ছিল মোহাম্মদ মাসরি। ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদা শুরুর পর তিনি হামাসে যোগ দেন। তখন তাঁর নাম হয় মোহাম্মদ দেইফ।
১৯৮৯ সালে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন দেইফ। তখন ১৬ মাস কারাগারে ছিলেন তিনি। হামাসের সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। সূত্রটি আরও জানায়, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন দেইফ। পদার্থ, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। তবে নানা বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কমিটির প্রধান ছিলেন। মঞ্চে অভিনয় করেছেন।
গাজায় হামাসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অসংখ্য টানেল বা সুড়ঙ্গ রয়েছে। এ নেটওয়ার্ক উন্নয়নে কাজ করেছেন দেইফ। এ ছাড়া তিনি হামাসের বোমা বানানোর প্রকল্পে ভূমিকা রেখেছেন। কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় দেইফের নাম রয়েছে।
পরিবার হারানো ব্যক্তি তিনি
হামাস–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে হত্যাচেষ্টায় দেইফ একটি চোখ হারিয়েছেন। সেই সঙ্গে পায়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে ইসরায়েলের বিমান হামলায় দেইফের স্ত্রী, সাত মাসের পুত্রসন্তান এবং তিন বছর বয়সী মেয়ের মৃত্যু হয়।
ফিলিস্তিনিদের কাছে একজন মুক্তির নায়ক মোহাম্মদ দেইফ। বারবার আঘাত, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, গোপন জীবন, পরিবারের সদস্যদের হত্যা—কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি। ফিনিক্স পাখির মতো ঘুরে দাঁড়িয়েছেন দেইফ। হামাসের সূত্র জানিয়েছে, স্মার্টফোনের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করেন না দেইফ। তিনি একজন রহস্যপুরুষ। তিনি অধরা, তিনি ছায়ার মানুষ।
অনুবাদ করেছেন অনিন্দ্য সাইমুম।