আসামি দুই পুলিশ কর্মকর্তা আড়াই মাস ধরে ছুটিতে

0
110
দুই পুলিশ কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন মজুমদার ও আবদুল আজিজ

আড়াই মাসের বেশি সময় আগে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলাটির তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

মামলার এজাহারভুক্ত আসামি দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রায় আড়াই মাস ধরে ছুটিতে আছেন। ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।

দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজিম উদ্দিন মজুমদার ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল আজিজ।

ডায়ালাইসিসের খরচ জোগানো একমাত্র ছেলেটি কারাগারে, দিশাহারা মা

মোহাম্মদ মুস্তাকিম ও তাঁর মা নাসরিন আক্তার
মোহাম্মদ মুস্তাকিম ও তাঁর মা নাসরিন আক্তার

নাজিম ও আজিজের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাটি করেন মোহাম্মদ মুস্তাকিম নামের এক যুবক। গত জানুয়ারিতে কিডনি রোগী মায়ের ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি পুলিশের হাতে আটক হন। পরে তাঁকে থানায় নিয়ে পুলিশ নির্যাতন করে বলে তিনি অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন।

মুস্তাকিমের করা মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. শাহনেওয়াজ খালেদ। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গত শুক্রবার তিনি বলেন, তদন্তের কাজ চলছে। তিনি বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, নাজিম ছুটিতে যান গত ১৯ ফেব্রুয়ারি। আর আজিজ গত ২১ ফেব্রুয়ারি ছুটিতে যান। তার পর থেকে তাঁরা ছুটিতে আছেন। আজ সোমবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁরা এখনো কর্মস্থলে ফেরেননি।

মায়ের ডায়ালাইসিসের খরচ জোগানো মুস্তাকিমের জামিন মঞ্জুর

ফৌজদারি মামলায় কোনো সরকারি কর্মকর্তা আসামি হলে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করার বিধান রয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুর রশিদ। তিনি গত বৃহস্পতিবার বলেন, নাজিম ও আজিজ দুজনই ফৌজদারি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। তাঁদের অবশ্যই আদালতে উপস্থিত হয়ে জামিন চাইতে হবে। কিন্তু তাঁরা এখনো জামিনের আবেদন করেননি।

ওসি নাজিমের বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চিঠি পাঠালেন মুস্তাকিম

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) উপকমিশনার (সদর) মো. আবদুল ওয়ারীশ শুক্রবার বলেন, অসুস্থতাজনিত ছুটি নিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তা ছুটিতে আছেন। তাঁরা ফেরার পর এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র চাওয়া হবে। দিতে ব্যর্থ হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেলে বা বিভাগীয় মামলা হলে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাহলে এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও কি পাওয়া যায়নি—এমন প্রশ্নে কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি আবদুল ওয়ারীশ।

বক্তব্য জানতে নাজিম ও আজিজের মুঠোফোনে গতকাল রোববার কল করা হয়েছিল। তবে তাঁরা ফোন ধরেননি। অবশ্য মামলা হওয়ার পর নাজিম ও আজিজ দুজনই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।

মুস্তাকিমের মামলার অভিযোগ

চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ বেগম জেবুননেসার আদালতে গত ২০ ফেব্রুয়ারি মামলা নেওয়ার আবেদন করেন মুস্তাকিম। মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গেলে মুস্তাকিমকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়। ঘটনার দিন থানায় নিয়ে যাওয়ার পর মুস্তাকিমকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। একটি নির্জন কক্ষে তাঁকে আটকে রেখে ওসির নির্দেশে এএসআই আজিজ মারধর করেন। তাঁকে বলা হয়, ‘ওসি স্যারের সঙ্গে আর বেয়াদবি করবি?

তোরে রিমান্ডে এনে আরও পিটাতে হবে। তারপর বুঝবি পুলিশ কী জিনিস।’ সে সময় মুস্তাকিম কোনো রাজনীতি করেন না বলে পুলিশকে জানান। গাউছিয়া কমিটি নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী হিসেবে তিনি কাজ করেন বলেও জানান। তখন তাঁকে বলা হয়, ‘তুই জঙ্গি’।

মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়, পুলিশের নির্যাতনে তাঁর পায়ের গোড়ালি থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাল দাগ হয়ে যায়। দুই দিন তাঁর প্রস্রাব বন্ধ থাকে। পরে প্রস্রাব হলে সঙ্গে রক্ত যায়। নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ না করার জন্য তাঁকে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। এ জন্য ভয়ে তিনি এত দিন মামলা করেননি।

বিচার চান মুস্তাকিমের মা

মুস্তাকিমের ৫৫ বছর বয়সী মা নাসরিন আক্তারের দুটি কিডনিই বিকল। তাঁকে সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। সাত বছর ধরে তিনি এভাবে ডায়ালাইসিস করে বেঁচে আছেন।

নাসরিনের স্বামী অনেক বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর একমাত্র অবলম্বন ২২ বছর বয়সী মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে মুস্তাকিম। তাঁর টিউশনির টাকাতেই নাসরিনের ডায়ালাইসিসের খরচ চলে।

ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে ১০ জানুয়ারি পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা হয়। পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করে। মামলায় পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগ করা হয়। মামলায় মুস্তাকিমের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয়ের ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়। এই মামলায় মুস্তাকিমকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

গত ১৩ জানুয়ারি ‘ডায়ালাইসিসের খরচ জোগানো একমাত্র ছেলেটি জেলে, দিশাহারা মা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন মুস্তাকিমের জামিনের জন্য লড়ে। পাঁচ দিন কারাভোগের পর গত ১৫ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান।

মুস্তাকিমদের গ্রামের বাড়ি হাটহাজারীর গুমানমর্দন এলাকায়। তবে তাঁরা চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ পাহাড়তলীর লালিয়ারহাট এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। শুক্রবার সেখানে গিয়ে নাসরিনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি  বলেন, তাঁর ছেলে কোনো দোষ করেননি। পুলিশ তাঁর ছেলেকে থানায় নিয়ে নির্যাতন করেছে। আবার মামলাও দিয়েছে। তিনি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চান। মুস্তাকিমও একই দাবি করেন।

মুস্তাকিমের পরিবারকে আইনি সহায়তা দিয়ে আসছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন। ফৌজদারি মামলা হলেও দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত না করায় বিস্ময় প্রকাশ করেন সংগঠনটির মহাসচিব জিয়া হাবিব আহসান। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে ভুক্তভোগী কেউ পুলিশের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে কোনো অভিযোগ বা মামলা করার সাহস করবে না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.