স্যানিটারি প্যাড: খুপরিঘর থেকে বিশ্বের নজরে এলেন নারী

0
179
দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলীয় কেপের শত শত স্কুলে বিনা মূল্যে স্যানিটারি প্যাড সরবরাহ করেন তামারা মাগওয়াশু।

তামারা মাগওয়াশুর পরিবারে আর্থিক অনটন ছিল। স্কুলে পড়ার সময় পরিবার তাঁকে স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে দিতে পারেনি। মাসিকের সময়টা স্কুলের সহপাঠীরা তামারাকে উপহাস করতেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলীয় কেপ প্রদেশের দরিদ্র শহরতলিতে বেড়ে উঠেছেন তামারা। বয়স এখন ২৭ বছর। তাঁর মা ‘একলা মা।’ ছোটবেলায় তিনি তাঁর মাকে মাসিকের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করতে দেখেছেন।

মাসিকের সময় তামারা স্কুল থেকে অন্তত এক সপ্তাহের ছুটি নিতেন।  অস্বস্তিকর হলেও মায়ের মতোই কাপড় ব্যবহার করা শিখতে হয়েছিল তাঁকে। ছোটবেলার সেই কষ্টকর অভিজ্ঞতাই এখন কাজে লাগাচ্ছেন তামারা। তিনি বলেন, ‘মাসিকের সময় আমি যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছি, তা অন্য কারও সঙ্গে হোক, তা চাইনি।’ মাসিকের সময় দরিদ্রদের যে কষ্ট পোহাতে হয়, তা দূর করতে নিজের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন তামারা। আর এখন সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই ইস্টার্ন কেপের কয়েক শ স্কুলে স্যানিটারি প্যাড বিতরণ করেন তিনি।

খুপরিঘর থেকে বিশ্বের নজরে

এই কাজের স্বীকৃতি পাওয়া শুরু করেছেন তামারা মাগওয়াশু। চলতি বছর তিনি মার্কিন ম্যাগাজিন ‘ফোর্বস’-এর ৩০ বছরের কম বয়সী উদ্যোক্তা ও সমাজ পরিবর্তনকারীর (চেঞ্জমেকার) ৩০ জনের তালিকায় (থার্টি আন্ডার থার্টি) মনোনয়ন পেয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয়।

ইস্ট লন্ডন শহরের ডানকান গ্রামে নিজের জীবনের কষ্টের গল্প বলেছেন তামারা। তিনি বলেছেন, পুরো জীবন তিনি একটি খুপরিঘরে কাটিয়েছেন। এই ঘরে কোনো জানালা ছিল না। পানির লাইন ছিল না।

চলতি বছর তামারা মাগওয়াশু মার্কিন ম্যাগাজিন ‘ফোর্বস’-এর ৩০ বছরের কম বয়সী উদ্যোক্তা ও সমাজ পরিবর্তনকারীর (চেঞ্জমেকার) ৩০ জনের তালিকায় (থার্টি আন্ডার থার্টি) মনোনয়ন পেয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয়।

স্কুল ছুটির পর তিনি খণ্ডকালীন চাকরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই চাকরির উপার্জন থেকে পরিবারকে সহায়তা করার ভাবনা ছিল। আরও ভেবেছিলেন মাসিকের সময়টা তিনি স্যানিটারি প্যাডের জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারবেন।

তামারা আরও বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি আমি কাজ শুরু করেছিলাম। যাতে আমার উপার্জনের অর্থ থেকে স্যানিটারি প্যাড কিনতে পারি। মাসিকের সময় কাপড় ব্যবহার করা খুব অস্বস্তিকর।’

তামারা আরও বলেন, মাসিক নিয়ে সে সময় জানাশোনা অনেক কম ছিল। এ কারণে কিশোরী বয়সে তিনি কেন মাসিকের সময় ব্যথা পাচ্ছেন, তা বোঝা খুব কঠিন ছিল। এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে শুধু তামারাই যাননি। অসংখ্য কিশোরী ও নারীরা এই পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গিয়েছেন, এখনো যাচ্ছেন।

পড়াশোনার পাশাপাশি আমি কাজ শুরু করেছিলাম। যাতে আমার উপার্জনের অর্থ থেকে স্যানিটারি প্যাড কিনতে পারি। মাসিকের সময় কাপড় ব্যবহার করা খুব অস্বস্তিকর।
তামারা মাগওয়াশু

দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা দ্য বোর্গেন প্রজেক্টের ধারণা, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় ৭০ লাখ কিশোরীর স্যানিটারি পণ্য কেনার সামর্থ্য নেই। বিশ্বব্যাংক বলছে, সারা বিশ্বে অন্তত ৫০ কোটি নারী মাসিকের সময় প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আর ইউএন উইমেন মনে করে, বিশ্বব্যাপী ১২৫ কোটি নারীর জন্য নিরাপদ, ব্যক্তিগত শৌচাগার নেই।

তামারা ও তাঁর পরিবারের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি ছিল। শহরতলিতে তাঁরা স্থানীয় প্রায় ৫০ জন মিলে একটি গণশৌচাগার ব্যবহার করতেন। এসব কারণে তামারা মনে করেন, দক্ষিণ আফ্রিকা শুধু বাইরে থেকেই চকচকে।

তামারা জোহানেসবার্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক রিলেশনস বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি যখন পড়াশোনার জন্য জোহানেসবার্গের বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, তখন থেকেই শিক্ষার্থী ঋণ থেকে নিজের ব্যবসা শুরুর জন্য অর্থ সঞ্চয় করতে থাকেন। পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি থেকেও আয় করতে থাকেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল অন্তত নিজ সম্প্রদায়ের মেয়েদের জন্য পরিবর্তন নিয়ে আসা।

ব্যবসার জন্য ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তামারা। কিন্তু তাঁর নামে কোনো সম্পদ ছিল না বলে পাননি। এ কারণে তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার পণ করেন। শেষমেশ ২০২১ সালে তিনি সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে মাসিকের পণ্য বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেন।

তামারা মাগওয়াশু।
তামারা মাগওয়াশু।ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

তামারা এই এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন আজোসুল। দক্ষিণ আফ্রিকার জোসা ভাষায় এর অর্থ হলো—‘সবার চোখের জল মোছা’। সাশ্রয়ী মূল্যে মাসিকের পণ্য বিক্রির পাশাপাশি তামারা লাভের একটি অংশ দিয়ে দাতব্য কাজও করেন। ‘শি নিডস ইউ’ নামে একটি ক্যাম্পেইন চালান তিনি। এর মাধ্যমে তিনি গ্রাম এলাকার স্কুলগুলোতে গিয়ে বিনা মূল্যে স্যানিটারি প্যাড বিতরণ করেন।

দ্য বোর্গেন প্রজেক্ট বলছে, স্যানিটারি টাওয়েল কিনতে পারে না বলে ওই সব এলাকার প্রায় ৩০ শতাংশ মেয়ে তাদের মাসিকের সময় স্কুলে যায় না।

যেন বড়দিনের মতো আনন্দ

তামারার সাবেক হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক থাজিয়া মন্যাকা তাঁর এই কাজে বেশ গর্বিত। তিনি বলেন, ‘তিনি মেয়েদের অনেক সাহায্য করছেন। তিনি এত প্যাড এনেছেন যে তা মেয়েদের ছয় মাসের জন্য যথেষ্ট। এটি তাদের কাছে বড়দিনের আনন্দের মতো ছিল। কারণ, এই মেয়েরা সুবিধাবঞ্চিত। তাদের একবেলার খাবার স্কুল থেকে দেওয়া হয়। তাহলে তারা কীভাবে স্যানিটারি প্যাড কিনবে?’

দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা দ্য বোর্গেন প্রজেক্টের ধারণা, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রায় ৭০ লাখ কিশোরীর স্যানিটারি পণ্য কেনার সামর্থ্য নেই। বিশ্বব্যাংক বলছে, সারা বিশ্বে অন্তত ৫০ কোটি নারী মাসিকের সময় প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আর ইউএন উইমেন মনে করে, বিশ্বব্যাপী ১২৫ কোটি নারীর জন্য নিরাপদ, ব্যক্তিগত শৌচাগার নেই।

স্কুলে মেয়েদের স্যানিটারি প্যাড দেওয়ার পাশাপাশি তামারা স্থানীয় প্রান্তিক নারীদেরও বিনা মূল্যে প্যাড দেন।

তামারার গ্রাম ডানকানের একজন নারী সাংবাদিক ইয়াজিনি কুসে। তিনিই প্রথম তামারার এই কাজ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি তাঁর কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তিনি কিশোরীদের মর্যাদা ও নারীর মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলছেন’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.