স্মৃতির মিনারে শ্রদ্ধার ফুল

0
167
স্মৃতির মিনার

অমর একুশের চেতনায় মঙ্গলবার বাঙালির কোটি প্রাণ যেন শহীদ মিনারে পরিণত হয়েছিল। এ যেন মায়ের ভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা- পোশাক, মনন ও স্লোগানে। ব্যানার-ফেস্টুনে শোভা পায় প্রিয় বর্ণমালা। বিনম্র শ্রদ্ধার পুষ্পার্ঘ্য হাতে হাঁটছেন সবাই খালি পায়ে। সব পথ এসে মিশেছে স্মৃতির মিনার শহীদ মিনারের পথে। এই শোক, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, শফিকদের প্রতি, ১৯৫২ সালের এই দিনে যাঁদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। বাঙালি পেয়েছিল মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার।

সর্বত্র বাংলা ভাষা প্রচলনের দৃঢ় অঙ্গীকার আর দেশ গড়ার দৃপ্ত শপথে পুরো জাতি পালন করেছে অমর একুশে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন; যাঁদের আত্মত্যাগে বাঙালি পেয়েছে ভাষার অধিকার; ফুল আর হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত বিনম্র শ্রদ্ধায় তাঁদের স্মরণ করেছে জাতি। একুশের প্রথম প্রহরে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় রক্তদানের অহংকারে উদ্দীপ্ত বাঙালির সব পথ যেন গিয়ে মিশেছিল শহীদ মিনারে। মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জয়ী বীর বাঙালি জাতি আবারও বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করল তার গর্বিত পূর্বসূরিদের। রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শহীদ মিনারের বেদিগুলোও ভরে উঠেছিল ফুলেল শ্রদ্ধায়। ফাল্কগ্দুনের ভোরের হিম হাওয়ায় নগ্ন পদে সবাই ছুটেছেন শহীদ মিনারের পানে। রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছিল লাখো মানুষের ঢল। পোশাকে শোকের কালো ব্যাজ, হাতে ফুল আর কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’ ধারণ করে ধীর পায়ে সবাই এগিয়েছে শহীদ মিনারের পানে। সেখানে ভাষাশহীদদের প্রতি ফুলেল শুভেচ্ছা আর শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

আজ ছিল সাধারণ ছুটি। ভাষাশহীদদের স্মরণে অর্ধনমিত ছিল জাতীয় পতাকা। সংবাদপত্রগুলোতে ছাপা হয়েছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দিনভর প্রচার করেছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। শহীদ মিনারে ভাষাশহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো ছাড়াও গর্ব আর শোকের এ দিনটি নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালিত হয়। দিবসের বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা, ভাষার বিকৃতি রোধ ও সর্বত্র বাংলা ভাষা প্রচলনে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান উচ্চারিত হয়েছে। উচ্চ আদালতসহ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন সবাই। একই সঙ্গে দেশ থেকে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ দূর করে সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় দৃঢ়স্বরে ব্যক্ত করা হয়েছে।

একুশের প্রথম প্রহরে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও সরকারের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে রাত সাড়ে ১২টার পর শহীদ মিনার জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। প্রবেশ করতে থাকে শ্রদ্ধার মিছিল। বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃৃতিক-রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লাখো মানুষের স্রোত এসে মেশে শহীদ মিনারে। সকালে মা-বাবার হাত ধরে ছোট্ট শিশুরাও এসেছে ভালোবাসার ফুল হাতে নিয়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়ে। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চলে শ্রদ্ধা নিবেদন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিএনসিসি এবং স্কাউট সদস্যদের অক্লান্ত ও নিবিড় তত্ত্বাবধানে সবাই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

বিশিষ্টজন যা বললেন: পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি গর্বের দিন। এই দিনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে। অথচ ৩৫ কোটি মানুষের মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা পায়নি। জাতিসংঘের কাছে আমাদের দাবি- আমাদের মাতৃভাষা বিশ্বের অন্যতম সেরা ভাষা হিসেবে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি পাবে। আমরা এই আশা করব।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, ভাষা আন্দোলন ছিল মুক্তিযুদ্ধের বীজ। তাই ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এক। সেটি হলো, এই দেশ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হবে। এ দেশের জনগণ নিজের হাতে ভোট দিয়ে নিজেদের মতো করে সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজকে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, তারা দেশের গণতন্ত্র হত্যা করেছে। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে তারা সব দলকে বাতিল করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে একদলীয় শাসন কায়েম করেছে।

তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ১৯৫২ সালের এই দিনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আমাদের পূর্বসূরিরা জীবন দিয়ে আমাদের ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু সেখান থেকেই। সেদিন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতির ওপর আঘাত হেনেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতির ওপর যারা আঘাত হেনেছিল, তাদের ভাবধারা ধারণকারীরা আজ স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও বাংলাদেশে রাজনীতি করে।

গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব ও ডাকসুর সাবেক সহসভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, স্বাধীনভাবে নিজের ভাব প্রকাশের জন্য, কথা বলা ও লেখার জন্য এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ভাষা আন্দোলনের কর্মীরা আন্দোলন করেছেন। কিন্তু আজকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিপীড়নমূলক আইনের কারণে মানুষের লেখা এবং স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার অনেকাংশে খর্ব করা হয়েছে। এটি ভাষাশহীদ এবং মাতৃভাষার প্রতি চরম বৈষম্য এবং নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা।

উচ্চ আদালতের সব রায় বাংলায় অনুবাদ করা হবে: সুপ্রিম কোর্ট থেকে প্রকাশিত সব রায় বাংলায় অনুবাদ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ভাষা অনুবাদে সুপ্রিম কোর্টে নতুন একটি প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে। সেখানে আমাদের কর্মকর্তারা যে রায়গুলো ইতোমধ্যে লিখেছেন, সেগুলো যাতে সুষ্ঠুভাবে অনুবাদ করা হয়, আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষাশহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।

এসেছিলেন বিদেশিরাও: ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বরাবরের মতো এবারও বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এসেছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। তাঁরাও একাকার হয়ে যান বাঙালির মিছিলে। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে শহীদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এসেছিলেন অনেক বিদেশি দম্পতিও।

রাষ্ট্রদূতদের শুভেচ্ছা বাণী: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোও। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন দূতাবাস থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, দিনটিতে সেই সব সাহসী বাংলাদেশিকে স্মরণ করা হয়, যাঁরা বাংলা ভাষায় পড়া, লেখা ও কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, গত চার বছর ধরে আমি এখানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত এবং আমি বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করেছি মাতৃভাষার প্রতি দৃঢ় ভালোবাসা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, আমি ডাচ ও ফ্রেঞ্চ জানি। আমি বাংলা শিখতে চাই।

এক ফেসবুক পোস্টে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ভারতীয় হাইকমিশনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, এ উপলক্ষে আসুন আমরা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন এবং এই দুই দেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের যৌথ অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করি।

শ্রদ্ধা জানাতে সাইকেলে চড়ে কলকাতা থেকে ঢাকায়: আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে কলকাতা থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে ঢাকায় এসেছেন এক দল ভারতীয়। আজ দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তাঁরা। পশ্চিমবঙ্গের ‘হান্ড্রেড মাইলস’ নামে একটি সংগঠনের আয়োজনে তাঁরা সাইকেল চালিয়ে ঢাকায় এসেছেন। তাঁরা খালি পায়ে হেঁটে শহীদ মিনারে এসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ভাষাশহীদদের প্রতি। আজই ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন তাঁরা। ১৫ জনের এ প্রতিনিধি দলের সদস্য গৌতম মৃধা বলেন, আমাদের স্লোগান- ‘বাংলা কখনও হয় না ভাগ; বাংলা ভাষায় আমরা এক’।

১০ দিন হেঁটে ঢাকায়: ভারতের মালদহ জেলা থেকে এসেছেন আলমগীর খান। তিনি টানা ১০ দিন হেঁটে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। মাতৃভাষা দিবসকে লক্ষ্য রেখে এ মাসের ৮ তারিখে কলকাতার বারাসাত থেকে তিনি পদযাত্রা শুরু করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। দু’দিন বিশ্রাম নিয়ে মঙ্গলবার সকালে তিনি শহীদ মিনারে পৌঁছান। তিনি বলেন, তিনি এ দেশে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং রক্তদানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এই পদযাত্রা করেছেন।

ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ: এদিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে একাধিক সংগঠন। শহীদ মিনারে ফুল দিতে আধাঘণ্টায় বলাকা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনে আসতে পারলেও হল থেকে শহীদ মিনারে আসতে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এ ছাড়া শহীদ মিনারে ফুল দিতে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম এবং বিএনসিসির সদস্যরা অসদাচরণ করেন বলে অভিযোগ করেছেন জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.