বিপণন পেশায় যুক্ত জার্মান নাগরিক বেনেডিক্ট বেকারের জন্য সিঙ্গাপুরে বসবাস ও দেশটিতে কাজ করা সব সময় ছিল ‘স্বপ্নের মতো’। ২০২০ সালে সিঙ্গাপুরের একটি বিপণন সংস্থায় চাকরিতে যোগ দেন তিনি।
বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের বৈচিত্র্য, এর সক্ষমতা, চমকে দেওয়ার মতো আকাশচুম্বী ভবন, সবুজ তৃণভূমি ও স্থাপত্যশৈলী বেকারকে বেশ আকৃষ্ট করে তুলেছিল।
চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর বেকার সিঙ্গাপুরের উত্তর দিকে এক শয়নক্ষের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন। ভাড়া মাসে ২ হাজার ৭২ মার্কিন ডলার। এ অ্যাপার্টমেন্টে থাকায় প্রতিদিন সকালে তিনি হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রসৈকতে যেতে পারতেন।
কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় দিনের পর দিন বাড়তে থাকায় বেকার ধাক্কা খান। নিজের আর্থিক অবস্থার কথা মাথায় আসে তাঁর। তিনি খেয়াল করেন, শুরুতে যেখানে অফিসে যেতে তাঁকে ৯ থেকে ১০ ডলার ট্যাক্সি ভাড়া দিতে হতো এখন সেটা ১৬ থেকে ১৮ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। তাঁর বন্ধুরাও জানাতে লাগল যে বাড়িওয়ালারা বাড়িভাড়া ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
২০২২ সালে সিঙ্গাপুরের প্রধান আবাসিক এলাকাগুলোতে বাড়িভাড়া ২৬ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এ হিসাব বৈশ্বিক রিয়েল এস্টেট কোম্পানি সাভিলসের। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, ওই বছর লন্ডন, নিউইয়র্ক ও সিডনির মতো শহরের তুলনায় সিঙ্গাপুরে বাড়িভাড়া বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।
এদিকে গত জানুয়ারিতে সিঙ্গাপুর সরকার পণ্য ও সেবার ওপর কর (জিএসটি) ১ শতাংশীয় বিন্দু বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করেছে। পরিকল্পনা আছে, আগামী বছর তা ৯ শতাংশ করা হবে।
আর্থিক সংগতি বিবেচনায় ৩৩ বছর বয়সী বেকার গত বছর সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আর সিঙ্গাপুরে থাকবেন না। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর যাবেন। সেখানে থেকে জার্মানভিত্তিক একটি স্টার্টআপের হয়ে কাজ করবেন। প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় ব্যবসা বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করছে। দূরে থেকে কাজ (রিমোর্ট ওয়ার্ক) হওয়ায় তাঁর বেতনও কমে।
এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আগের চেয়ে ‘অনেক বেশি সঞ্চয়’ করতে পারছেন বলে জানান বেকার।
বেকারের মতো অবস্থা সফটওয়্যার প্রকৌশলী উইল ফংয়ের। সিঙ্গাপুরে বাড়িভাড়া ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তিনিও বেকারের মতো আর্থিক অবস্থার বিষয়টি উপলব্ধি করতে শুরু করেন, যখন দেখেন তাঁর বাড়িওয়ালা এক শয়নকক্ষের যে অ্যাপার্টমেন্টে তিনি থাকতেন সেটির ভাড়া এক ধাক্কায় ১ হাজার ৯২৪ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ৫৯১ ডলার করার কথা বলেন। এরপর যাঁর মাধ্যমে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, তাঁকে দিয়ে বাড়িওয়ালাকে বুঝিয়ে বাড়িভাড়া ২ হাজার ২২০ ডলারে রফা করেন।
এরপর মার্কিন নাগরিক ফংও বেকারের মতো দূরে থেকে অফিসের কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বেছে নেন ভিয়েতনামকে। প্রথমে দুই সপ্তাহের জন্য যান দেশটির হো চি মিন শহরে। এরপর এক মাসের জন্য যান দা নাং শহরে। তিনি পরিকল্পনা করেছেন, সিঙ্গাপুরে একটি কক্ষ ভাড়া নেবেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ঘুরে ঘুরে কাজ করার জন্য ওই কক্ষটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করবেন।
সিঙ্গাপুরে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি আছে ফংয়ের। তিনি বলেন, এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে ঘুরে কাজ করেও সিঙ্গাপুরের চেয়ে জীবনযাত্রার খরচ আগের চেয়ে অনেকটা কম হবে।
আরও অনেক অভিবাসী সিঙ্গাপুর ছেড়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন। এসব শহরে জীবনযাত্রায় ব্যয় সিঙ্গাপুরের তুলনায় অনেক কম। করোনা মহামারির পর অর্থনীতিতে নতুন করে গতি আসার কারণে সিঙ্গাপুরে জীবনযাত্রার ব্যয় এত বেড়েছে যে এসব অভিবাসী বাধ্য হয়েই সিঙ্গাপুর ছেড়ে এ অঞ্চলের অন্যান্য শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন।
তবে সিঙ্গাপুর ছেড়ে কতসংখ্যক অভিবাসী কর্মী চলে গেছেন, দেশটির সরকারের কাছে সেই হিসাব নেই। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে তাঁদের কর্মীদের সিঙ্গাপুর থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যাও বাড়ছে বলে জানাচ্ছে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
মালয়েশিয়াভিত্তিক নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান মাইকেল পেজ মালয়েশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিক চেম্বার্স বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে কর্মী সরিয়ে নিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রথম পছন্দ মালয়েশিয়া। কারণ এর ভৌগোলিক অবস্থান, ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষ, জীবনযাত্রার ব্যয় কম আর অফিস ব্যবস্থাপনা।
নিয়োগদাতা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি আছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান টেনটেন পার্টনার্স। প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা লুক আর্চার বলেন, ‘পশ্চিমা দেশগুলোর লোকজন এমন দেশে কাজ করতে চান, যেখানে কর দিতে হয় কম, কিন্তু জীবনযাত্রার মান বেশ ভালো। অবকাঠামো, কম কর ও পরিবারের জন্য উপযোগী পরিবেশ বিবেচনায় সিঙ্গাপুর এখনো তাঁদের কাছে পছন্দের দেশ। কিন্তু দ্বিতীয় সারির নির্বাহীদের যে বেতন, তা দিয়ে দেশটিতে থাকা বেশ ব্যয়সাধ্য। এখন আমরা অনেক অভিবাসীকে মধ্যপ্রাচ্যে থাকার ব্যবস্থা করছি।’
বেকার সিঙ্গাপুর ছেড়ে চলে যাওয়াতে খুশি হলেও তিনি বললেন, সিঙ্গাপুরের কিছু জিনিসের অভাব বোধ করেন। কারণ সেখানে এমন কিছু সুবিধা আছে, যা অন্য কোথাও নেই। এ জন্য তিনি ব্যবসায়িক কাজে প্রতি দুই বা তিন মাস অন্তর একবার করে সিঙ্গাপুরে এসে ঘুরে যান।
বেকার বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের প্রাণবন্ত নতুন নতুন ব্যবসায়িক উদ্যোগ এবং কর্মপরিবেশের অভাব বোধ করি। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্তসম্পর্ক তৈরির একটা বিষয় আছে। যোগাযোগের নানা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিপণন খাতের বিশেষজ্ঞদের দেখা মিলত হামেশাই। এই দিকটি বিবেচনায় নিলে কুয়ালালামপুরের তুলনায় সিঙ্গাপুরে অনেক বেশি সুবিধা পাওয়া যায়।’